দুর্গা দুর্গতিহারিনীম



Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays…
দেবী দূর্গা, মূলত অনার্য দেবি জিনি যুগ যুগ ধরে সমগ্র পূর্ব ভারতে পূজিত হয়ে আসছেন।এই গল্পে পাবেন পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি দুর্গোৎসবের ইতিহাস।
লেখক : সন্দীপ ঘোষ
আর্য পুরাণে দেখা যায় শূদ্র বাদে ব্রাহ্মাণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সকলেই দুর্গা পুজা করেছেন।আর্য পুরাণে শূদ্ররা খলনায়ক, তাই এদের কোনও ঠাই হয়নি।
আর্য সভ্যতায় প্রাধন্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য দেবিদের, তাঁরা পুজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। বাইশ হাজার বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবীপুজার প্রচলন হয়েছিল।
ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ অনুসারে দুর্গা পুজার প্রথম প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ। দ্বিতীয়বার পুজা করেন ব্রহ্মা ও তৃতীয়বার মহাদেব।
ভাগব্যপুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোদ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভ করেন।
মুল বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব নেই তবে কৃত্তিবাস রামায়ণে এর উল্লেখ আছে। সত্যযুগে রাজা সুরত ও বৈশ্যসমাধি এবং প্রচলিত কথায় দুর্গ নামক আসুরকে বধ করায় দেবীর নাম হয় দুর্গা। পূর্ব ভারতের বিজয়া দশমীই দক্ষিণ ভারতের নবরাত্রি, উত্তর ভারতে যা দশেরা নামে পরিচিত। দশেরার আর্থ দশহরা অর্থাৎ দশ রকম পাপ হরণ করে গঙ্গার আগমনের দিন।
১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপুজা করেন।১৫১০ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ পুজার আয়োজন করেন। ১৫৮০-তে তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ পুজা করেন। ১৬০৬-এ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদারের পুজা শুরু হয়। ১৬১০-এ বরিশার সাবর্ণ রায় চৌধুরি পরিবারের পুজা চালু হয়। ১৭১১-তে আসামের তৎকালীন রাজধানী রংপুরে, ১৭৫৯-য় শোভাবাজার রাজবারিতে এবং ১৭৯০-তে হুগলির গুপ্তি পাড়ায় প্রথম বাংলার বারোয়ারি দুর্গা পুজা শুরু হয়। ১৮৩২ সালে কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ দ্বারা কলকাতায় পুজা চালু হয়। ১৯১০ সালে শুরু হয় কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজা বলরাম বসু ঘাট লেনে, উদ্যোক্তা ভবানীপুরের সনাতন ধর্মৎসাহিনী সভা। এছাড়া রামবন মিত্র লেনে ও সিকদার বাগানেও বারোয়ারি পুজা চালু হয়। এই বারোয়ারি দুর্গাপুজা চালু হওয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। এই প্রসঙ্গে তা বলে নেওয়া যেতে পারে। হুগলির গুপ্তিপাড়ার কয়েক জন বন্ধু একবার কলকাতার বনেদী বাড়ির (সম্ভবত রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে) পুজা দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু রাজবাড়ির লেঠেল ও পাহারাদারেরা তাদের প্রবেশ করতে দেয়না। তাদের অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। লজ্জায়, অপমানে আহত বন্ধু বা ইয়াররা প্রতিজ্ঞা করেন, বনেদী বাড়ির বাইরে তারা পুজার আয়োজন করবেন সাধারণ মানুষের জন্য, যা ব্যক্তিগতও উদ্যোগে নয় আয়োজিত হবে জনসাধারণের উদ্যোগে। সম্ভবত সেই ইয়াররা সংখ্যায় ছিলেন বারোজন তাই তাঁদের আয়োজিত পুজা বারোয়ারি নামে পরিচিত হয়।
একটা কথা জেনে রাখা ভালো যে, আদিবাসীদের কাছে দুর্গাপুজা কোনও আনন্দোৎসব নয় বরং বেদনাবিধুর। রাবণ, মহিষাসুর সকলেই অনার্য বীর। যাকগে, অসুর কাহিনি অন্য কোনও সময় শোনা যাবে। ফিরে আসি দুর্গাপুজায়।
ব্রিটিশ বাংলায় দেওয়ানি পাওয়ার পর হিন্দুদের তুষ্ট রাখতে ১৮৭৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি দ্বারা দুর্গাপুজার আয়োজন করা হয় এবং তা চলে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। ১৯১০/১১য় দিল্লিতে দুর্গাপুজা চালু হয়।
কথিত আছে মা এসে জোড়াসাঁকোর রাজবারিতে গয়না পরেন, দুপুরে খান কুমোরটুলির অভয় চরণ মিত্রের বাড়িতে আর রাতে নাছগান দেখেতে যান শোভাবাজার রাজবারিতে। দেখাযাক পুজোর ভোজ কোন বনেদী বাড়িতে কেমন হত। বরিশার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর বাড়িতে কলাই ডাল ও মশলা বড়ি থাকবেই। বড়বাজার মল্লিক বাড়িতে ভাজাভুজি, লুচির সঙ্গে আলু ও পটল ভাজা, ধোঁকার ডালনা, চার পাঁচ রকমের মিষ্টি। বাগবাজার হালদার বাড়ির নাড়ু বিখ্যাত। গিরিশ পার্কের দাঁবাড়িতে ৪৫টি থালায় খাবার সাজানো হয়, জ্বালানো হয় ১০৮টি প্রদিপ। বলরাম দত্ত বাড়িতে রাধাবল্লভি, খাস্তা কচুরি, লুচি, লেডিকিনি, দরবেশ ও নাড়ু।শোভাবাজার রাজ বাড়িতে নবমীর দিন মেটে চচ্চোরি থাকবেই। কুমারটুলির অভয় মিত্রর বাড়িতে তৈরি হত পেল্লাই সাইজের মিষ্টি।
দুর্গাপুজার সঙ্গে ‘ডাকের সাজ’ শব্দটি জুরিয়ে আছে। শোভাবাজার রাজবাড়িতে প্রথম চালু হয় silver foil বা রাংতার অলংকার, যা ভারতে পাওয়া যেতনা বলে তা আমদানি করতে হত জার্মানি থেকে এবং তা আসত ডাকযোগে। তাই এটিকে বলাহত ডাকের সাজ।
দুর্গাপুজার সঙ্গেই জুরিয়ে আছে মহালয়া। পুজর পনেরো দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়। মহা যুক্ত আলয় মহালয়াতে পিতৃপক্ষের শেষ ও দেবী পক্ষের শুরু। এই দিন ভোরবেলা পিতৃপুরুষের উদ্দেস্যে তিল জল প্রদান করা হয়, যাকে আমরা বলি তর্পণ। তর্পণ এসেছে ‘ত্রপ’ শব্দ থেকে যার অর্থ তৃপ্ত বা সন্তুষ্ট করা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথি থেকে অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত, এই পনেরো দিন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করা হয়। রামায়াণ, মহাভারতে তর্পণের উল্লেক পাওয়া যায়। তর্পণের উদ্দেশ্য পাপস্খালণ ও সুখ শান্তি প্রাপ্ত হওয়া।
শেষের দাঁড়ি টানার আগে জানাই, দুর্গাপুজার উপকরণ হিসেবে যে নবপত্রিকার নাম শোনা যায় তা নটি গাছ এবং প্রতিটি গাছ এক একজন দেবির প্রতীক। ১) কলাগাছ – বৃক্ষ্মীর, প্রতীক ২) ধা্নগাছ – মহালক্ষ্মীর , ৩) হলুদগাছ – উমা ৪) মানকচু – চামুণ্ডার, ৫) কালকচু – কালিকা, ৬) ডালিম – রক্তদন্তিকার, ৭) বেল – শিবের, 8) অশোক – দুর্গার, এবং ৯) জয়ন্তীর ডাল কার্তিকার প্রতিক। দুর্গাপুজায় সন্ধিপুজার উল্লেখ না করলেই নয়, তাই অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট নিয়ে মোট ৪৮ মিনিট হল সন্ধিপুজার সময়কাল। এই সময় দেবী অম্বিকার তৃতীয় নয়ন থেকে দেবী কালিকার আবির্ভাব। চামুন্ডা কালিকার দৃষ্টিপথের মধ্যে থাকতে নেই । সন্ধিপুজায় প্রয়োজন হয় ১০৮টি পদ্ম ও ১০৮টি প্রদীপের। উপনিষদের দুর্গা গায়ত্রিতে অগ্নিবর্ণাদুর্গার উল্লেখ আছে। ইনিই ব্রহ্ম বিদ্যা। কেনোপনিষদে উমার নাম হেমবতী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী একাধারে মহামায়া ও চিন্ময়ী, রুপে সর্বপ্রথম আখ্যাত হয়েছেন।
সবার পুজা ভালো কাটুক।
What's Your Reaction?

Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays clear of politics, sports or regular curricular studies, but loves learning varied issues. His personal romance is theatre. Now 61, he has worked in various embassies and private organisations, but ploughs himself back into acting whenever he can. His latest book is titled “Theatre in the Districts and Suburbs”