তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় -১২৫ তম জন্মবার্ষিকী
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
চৈতালি ঘূর্ণি’, ‘আগুন’, ‘ধাত্রী দেবতা’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘গণদেবতা’ — প্রভৃতির স্রষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ১২৫ তম জন্মবর্ষে আমরা, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোরি’র পক্ষ থেকে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জি।
শ্রদ্ধেয় কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে কিছু বলার আগে একথা স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন যে, আমি প্রথাগতভাবে সাহিত্যের ছাত্র নই। সেহেতু তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলা মানে অনেকটা বটবৃক্ষের তলায় অযত্নে বেড়ে ওঠা তৃণদলের বটবৃক্ষ সম্বন্ধে কিছু বলার সমান। আমার মতন অতি নগণ্য, অনামী এবং অখ্যাত কলমচিকে তারাশঙ্করের মতন বটবৃক্ষের উপর কিছু লিখতে বললে, সে বটবৃক্ষের ছায়ার কথাই যে বলবো, তা সহজেই অনুমেয়।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের জেলার লাভপুরে ২৩ শে জুলাই ১৮৯৮ সালে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। রাঢ বাংলায় জন্মেছিলেন বলেই হয়তো তাঁর রচিত উপন্যাস, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা‘ ইত্যাদি লেখায় সে যুগের গ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। এতদিন ধরে যা সাহিত্যের মঞ্চে ব্রাত্য ছিল — রাঢ় বাংলার জমি, গাছপালা, ভাগাড়, বাগদি, নাপিত, ঝুমুর গানের দল, সাপুড়ে, কসাই, ভিখারী, দেহপসারিণী — তারাশঙ্করের কলমের আলোয় তাঁরা আর ব্রাত্য নন। সাহিত্য মঞ্চের এক একজন কুুশীলব হয়ে উঠেছেন।
‘কল্লোল’ পত্রিকায় ‘রসকলি’র মাধ্যমে তারাশঙ্করের সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ। এছাড়া সেকালের ‘বঙ্গশ্রী’, ‘প্রবাসী’ ইত্যাদি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশ হত। প্রথম উপন্যাস, ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ সালে তারাশঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গণদেবতা’ প্রকাশিত হয়। ‘গণদেবতা’কে তারাশঙ্করের কীর্তির একটি মাইলস্টোন বললে বোধহয ভুল বলা হবে না। ‘গণদেবতা’র মধ্যে দিয়ে তিনি রাঢ় বাংলার গ্রাম্য রাজনীতি, শোষণের ছবি, ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। গ্রামের মাতব্বর ছিরু পাল (শ্রীহরি পাল) নিজেকে জাতে তোলার প্রানপণ চেষ্টা, অন্যায় উপায়ে, ঠকিয়ে গরিবের সবকিছু আত্মসাৎ করার ঘৃণ্য কৌশল –পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাস পড়লে মনে হয় যেন ‘গণদেবতা’র দ্বিতীয় খন্ড।
কোপাই নদীর বিখ্যাত বাঁকে প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে লেখা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। বাবু মাইতো ঘোষ কে ট্রেন ধরিয়ে কহার পাড়ার মাতব্বর, বনওয়ারী একটা সিকি বকশিশ পেয়ে খুশি। দিনমজুর, মালিকের থেকে এতটুকু বদন্যতায় খুশি হবে, এটাই দস্তুর। বনওয়ারীদের সনকড়ারী খাজনার শর্ত – পতিত জমি গায়ে-গতরে খেটে তাকে আবাদ জমি করবে। প্রথম এক বছর বা দু’বছর খাজনা মুকুব। তারপর জমিতে যখন সোনার ফসল ফলতে শুরু করবে, তখন বাবুর গোলায় উঠবে সিকি ভাগ ফসল খাজনা; তারপর আট আনা ফসল খাজনা; তারপর পুরো ফসল খাজনা। এমনি করে চলবে এগারো বছর। তারপর আবার নতুন শর্ত। বনওয়ারী তার বাপের কাছ থেকে শুনে এসেছে “মনিবের ঘরে মা লক্ষ্মী উঠবেন, উঠোনে তাঁর পায়ের ধুলো পড়বে- তাই কুড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে আসবি, নিজেদের পেট ভরবি”। অদ্ভুত দাসত্বের কথা।
এরকম মর্মস্পর্শী লেখার মাধ্যমে তারাশঙ্কর বুঝিয়ে গেছেন মনিব চাকরের বিভেদ এক আলোকবর্ষ। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র প্রকাশকাল ১৯৫১ সাল। বনওয়ারীদের এপ্রকার জীবন পড়তে পড়তে ১৯৪৬ সালে দিনাজপুর জেলায় ‘তেভাগা আন্দোলন’ এর কথা স্মরণে আসে।
গ্রামের ঘেরা টোপের জীবন যুদ্ধের গল্প থেকে বেরিয়ে অন্য পরিসরে নিজেকে মেলে ধরেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ ‘সপ্তপদী’ তার একটি নমুনা মাত্র। ১৯৬১ সালে অজয় কর মহাশয়ের নির্দেশনায় গল্পটির চলচিত্রায়ন ঘটেছিলো। বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে এই গল্পের হাত ধরে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি উপন্যাস বা গল্প নিয়ে আলোচনা করতে বসলে প্রবন্ধটির আয়তন যে বিশাল রূপ নেবে সেটা পাঠক/পাঠিকাকে বলে দিতে হবে না।
যাঁর কীর্তি মানুষের মন ছুঁয়ে যায়, তাঁর মুকুটে পুরস্কারের পালক থাকবে না — তা কখনো হয়! সাহিত্য একাডেমী, জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ — সব সম্মানে তিনি ভূষিত। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তঁকে মনোনীত করা হয়েছিল। যদিও সেই বছর সাহিত্যে নোবেল পান চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা। ষাট টির বেশি উপন্যাস এবং প্রায় দু’শ ছোটগল্পের রূপকার তারাশঙ্করের মৃত্যু হয় ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে।
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী অধ্যায়ে তারাশঙ্কর ছিলেন বাংলা সাহিত্য জগতে লুব্ধক নক্ষত্রের মতন। পৃথিবীর আকাশে যেমন লুব্ধক নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা সবচাইতে বেশি, সেই রকম তারাশঙ্করের সৃষ্টির জ্যোতি অন্য সকল লেখক লেখিকার সৃষ্টিকে ছাপিয়ে গেছে। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অন্য সবাইকে আলো দেখিয়ে গেছেন, জুগিয়েছেন লেখার অনুপ্রেরণা।
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.