ডঃ বিধান চন্দ্র রায়



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
আজ প্রবাদ পুরুষ ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্ম দিবস। সেই উপলক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোরির পক্ষ থেকে আমাদের একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। কলমেঃ রাজকুমার মুখার্জী
“আপনাদের শরীর খারাপ হলে অবশ্যই ডাক্তারদের কাছে যাবেন, কারণ ডাক্তারদের তো বাঁচতে হবে; ডাক্তারবাবুরা যা ওষুধ লিখে দেবেন, তা অবশ্যই দোকান থেকে কিনবেন, কারণ দোকানদারদের তো বাঁচতে হবে; বাড়ি এসে সেইসব ওষুধ ফেলে দেবেন, কারণ আপনাকেও তো বাঁচতে হবে।” –মজার ছলে রোগীদের এইরকম বলতে শোনা যেত ডঃ বিধান চন্দ্র রায় কে।
আজ ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মদিন। আমরা তাঁর জন্মদিন কে ডক্টরস ডে হিসেবে পালন করি। আসুন সেই ডঃ রায়ের সম্বন্ধে কিছু মিথের কথা বলি।
ডঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রথম থেকেই যে ডাক্তার হবেন, এইরকম কিছু ঠিক করেন নি। ডাক্তারি পড়বার জন্য মেডিকেল কলেজে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্য শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আবেদন করেন। ডাক্তারিতে ভর্তি হবার পর শিবপুর থেকে তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার জন্য ডাক পাঠানো হয়। ততক্ষণে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে গেছেন। আর কি করা?
মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। বাধ্য হলেন পার্ট টাইম ট্যাক্সি চালাতে। মাত্র বারোশো টাকা সম্বল করে বিলেতে FRCS এবং MRCP পড়তে চললেন। দু বছরের মধ্যে একইসঙ্গে FRCS এবং MRCP পাশ করেন, যা অতি বিরল ঘটনা।

ডঃ বিধান চন্দ্র রায় খুব রসিক ব্যক্তি ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী তখন আগা খান প্যালেসে, তাঁর এঙ্কাইলো স্টোমাইসিস রোগ ধরা পড়ে। ডঃ রায়ের ডাক পড়লো। ডঃ রায় সব দেখে গান্ধীজি কে ওষুধ দিলেন। গান্ধীজী এলোপ্যাথি ওষুধ ভরসা করেন না। গান্ধীজি ডাক্তার রায়কে বললেন “দেখো বাপু তুমি দেশের চল্লিশ কোটি লোককে তোমার চিকিৎসা দিতে পারো না। আমি তোমার চিকিৎসা নেবো কি করে?” ডাক্তার রায় বললেন “আপনার কথা একদম ঠিক। আমি সবার চিকিৎসা করতে পারি না, কিন্তু যিনি এই চল্লিশ কোটি মানুষের কথা ভাবেন, যাঁর বেঁচে থাকায় এই চল্লিশ কোটি মানুষের উপকার হয়, সেই চল্লিশ কোটি মানুষ যে আমাকে আপনার চিকিৎসার ভার দিয়েছেন — সেটা উপেক্ষা করি কি করে?” গান্ধীজি বললেন “আমি তো এলোপ্যাথি ওষুধ খাই না।” ডাক্তার রায় বললেন “আপনি তো বলেন আমাদের যা কিছু সবই এই প্রকৃতির, এই পৃথিবীর। আপনি বলুন তাহলে আমার এলোপ্যাথি ওষুধ পৃথিবীর বাইরে হ’ল কি করে?” গান্ধীজি বললেন “তুমি তো দেখি মফস্বলের থার্ড ক্লাস উকিলের মতন জেরা শুরু করলে, তুমি তো ডাক্তার এসব জানলে কি করে? ঠিক আছে, দাও তোমার ওই এলোপ্যাথি ওষুধই দাও, খাই।” ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি মহাত্মা গান্ধীর মত দুঁদে ব্যারিস্টারকেও ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো।
একবার গান্ধীজি ডক্টর রায়কে মজা করে বলেছিলেন “তোমাকে যুক্তরাজ্যের গভর্নর করতে চাইলাম তুমি নিলে না। আমি তোমায় তাহলে His Excellency বলতাম।” ডক্টর রায় মজা করে উত্তর দিলেন “আমার পদবি Roy, আপনি আমায় Royal বলতে পারেন। আমি সবার চাইতে লম্বা, চাইলে আমাকে Royal Highness ও বলতে পারেন।”
এবার বলি ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের ডাক্তার হিসেবে দু একটি মিথের কথা। একবার এক বাচ্ছার টিবি হয়েছে। বাচ্চাটির বাবা ডক্টর রায় কে বাড়িতে কল দিয়ে নিয়ে গেছেন। ডঃ রায় সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন, একটি বাচ্চা ছেলের কাশির শব্দ। ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের সিঁড়িতে দাঁড়ালেন, শব্দটা শুনলেন, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। বাড়ির সকলেই অবাক। বাচ্চাটির বাবা বললেন “আপনি রোগীকে দেখবেন না?” ডক্টর রায় বললেন “বাচ্চাটি যে গরুর দুধ খায় সম্ভবত গরুটির টিভি হয়েছে। দুধ বদলান।” সেই সঙ্গে কাশির ওষুধ লিখে দিলেন। ব্যাস বাচ্চাটি দুদিনে সুস্থ।
আরেকটি ঘটনার কথা বলি। তখন ডঃ বিধান চন্দ্র রায় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশ ছিলো বিকেল পাঁচটার পর মহাকরণে কেউ থাকবে না। এমনকি লিফটম্যানও নয়। থাকতো ওনার আপ্তসহায়ক সুশান্ত বাবু এবং একজন পুলিশের সার্জেন্ট। কোনো পাইলট কার ব্যবহার করতেন না। পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা অবধি ফাইল দেখতেন। একদিন প্রায় নটা বাজে, মহাকরণ ছেড়ে চলে যাবেন, সেই সময় এক সাফাই কর্মী তিন তলায় ঝাঁট দিচ্ছে এবং কাশছে। উনি সুশান্ত বাবুকে বললেন সাফাই কর্মীকে ডাকতে। সুশান্ত বাবু ভাবলেন এবার বোধহয় ওই কর্মীর চাকরি গেলো। সাফাই কর্মীকে ধমক দিয়ে বললেন “আপনার কি ব্যাপার মশাই, আপনি এখনো এখানে?” কর্মী হাত জোড় করে চাকরি ভিক্ষে করতে লাগলো। উনি হেসে বললেন “ওরে ব্যাটা, আগে জীবন বাঁচা, তারপর তো চাকরি।” সার্জেন্টকে ডেকে বললেন আমার গাড়ি করে একে এখনই যাদবপুর টিবি হাসপাতালে নিয়ে যান। এর গ্যালপিং টিবি হয়েছে। হাসপাতালে সুপারকে আমার নাম করে বলবেন। সুশান্তবাবুর কেমন সন্দেহ হলো, পরদিন সকালে সুশান্তবাবু হাসপাতালের সুপার কে ফোন করে বললেন “ডক্টর রায় জানতে চাইছেন কালকের পেশেন্ট কেমন আছেন?” সুপার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন “দূর মশাই, এইতো একটু আগে ডক্টর রায়, আমায় ফোন করে সব জানতে চাইলেন। বললাম গ্যালপিং টিবি হয়েছে। কি কি ওষুধ দেওয়া হবে, সে সম্বন্ধে ওনার সঙ্গে আলোচনা হলো।”
সেই দিনই মহাকরণে এসে সাফাইকর্মীর ফাইলটা চেয়ে পাঠালেন, তারপর সুশান্ত বাবু কে বললেন “একে সবেতন ছুটি দিয়ে দাও।” সুশান্ত বাবু বললেন “আমি এটা পারি না, ওটা আমাদের পলিসিতে নেই।” ডাক্তার রায় বললেন “নিকুচি করেছে তোমার পলিসি।” বলে নিজেই ফাইলে খসখস করে লিখে দিলেন ‘Leave with pay till recovery’. নিচে সই করে বললেন “বিশ্রাম না পেলে, ও ব্যাটা এমনি মরে যাবে।”
১৯৪৩ সালে দেশবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে যোগদান করেন। নিজের ডাক্তারি পেশায় তখন তার মাসিক আয় ৪২০০০ টাকা। তখন সোনার বাজার দর ছিল ৬৮.৬২ টাকা আজ সেটা প্রায় ৫৫০০০ টাকা। অর্থাৎ ৭০০ গুণ। এই হিসেবে আজকের বাজার দর অনুযায়ী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মাসিক আয় ৩ কোটি টাকা।
তাঁর রোগীর নামের তালিকায় শুধু সাধারণ গরিব মানুষ ছিলেন, তা নয়। তাঁর রোগীর নামের তালিকায় ছিলেন মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৎকালীন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাথলি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি প্রভৃতি।
১৯৪৮ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। আমৃত্যু এই পদে ছিলেন। তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় চিত্তরঞ্জন লোকোমেটিভ, দুর্গাপুর ইস্পাত, কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন, হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ, সল্টলেক সিটি, কল্যাণী ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙালি ছেলেদের স্বনির্ভর করার জন্য বেবী ট্যাক্সির লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেন। ১৯৬১ সালে ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৬২ সালের ১লা জুলাই চলে যান না ফেরার দেশে। এইরকম ব্যক্তিকেই তো বলে “প্রবাদ পুরুষ” ইংরেজি তে “The Proverbial Man”
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.