Now Reading
জ্যাঠামশাই আর তাঁর গরুরা

জ্যাঠামশাই আর তাঁর গরুরা

Avatar photo
জ্যাঠামশাইর গরুরা

বাড়িতে অনেকেই গরু পোষেন। ভালো দুধ খাবেন, খাঁটি দুধ খাবেন। তার জন্য দুটো একটা গরু পোষেন কিন্তু গরুর সঙ্গে সখ্যতা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে গরুকে মশারি টাঙিয়ে শোয়াতে হয়! গরু খাটে উঠে শুয়ে পড়েস। এরকম কখনো শুনেছেন? শোনেননি তো! তাহলে পড়ুন জ্যাঠামশাই আর তাঁর গরুর গল্পটি।

আজ আপনাদের বলবো আমার মায়ের জ্যাঠামশাই আর তাঁর গরুদের গল্প। মানুষটির বাড়ি ছিল মামাবাড়ির কাছেই। প্রথমেই বলে রাখি – মায়ের জ্যাঠামশাই আমারও জ্যাঠামশাই, আসলে মা তাঁর গুরুজনদের যে নামে ডাকতেন আমিও সেটাই ফলো করতাম। যেই হোক, ভদ্রলোকের জীবনে দুটি নেশা – এক গরু, আর দুই- তাস। কোনো কিছুর জন্যই এই দুইয়ের ব্যাপারে কখনো কম্প্রোমাইজ করেননি।

পোষ্য নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে কি ফল হয় তা- ব্যাসদেব জড় ভরতের উপাখ্যানে বলে গেছেন; এক হরিণশিশুর প্রেমে অমন মহাজ্ঞানী ভরত রাজার ইহকাল পরকাল দুইই গিয়েছিল ! কিন্তু সদুপদেশে কে আর কবে কান দিয়েছে ?
শুনেছি, যখন বদলির চাকরি করতেন – জ্যাঠামশাই কোয়ার্টারে গরুদের রাখতেন। বউ ছেলেপুলে নিয়ে নিজে এক কোণে পড়ে থাকতেন, আর বাসস্থানের সিংহভাগ জুড়ে থাকতো গরুরা। একবার পোষ্যদের নিয়ে পড়শী কলিগের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায়- ধারকর্জ করে খড়দায় বাড়ি বানান। সেখানে নিজেদের ঘর হল যেমন তেমন, কিন্তু গরুর খাসা ঘরখানা দেখলে – সুইটজারল্যান্ড কি হল্যান্ডের গরুদেরও নিশ্চই হিংসে হত !
জরু গরু সেখানে রেখে, বাড়ির পুরনো চাকর দয়ালের ওপর গোয়ালের ভার দিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে জ্যাঠামশাই কর্মস্থলে চললেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও শান্তি পান কোথায় ? সদা দুশ্চিন্তা – দয়ালদা নির্ঘাৎ তাঁর চোখের মণিদের কম খেতে দেয়, সারাদিন কড়া রোদে দাঁড় করিয়ে রাখে… রাতে মশারী টাঙাতে ভুলে যায় হয়তো… আহা ! সারা রাত মশা কামড়ায় বাছাদের …
আর এমনই কপাল – গিন্নীর সামনে হা হুতাশ করার জো নেই, গরুগুলোকে তিনি সতীন বলে মনে করেন, দুচক্ষের বিষ !
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে – জ্যাঠামশাই কোলকাতায় পার্মানেন্ট পোস্টিং জোগাড় করলেন। গিন্নী কোথায় খুশি হবেন, না, উল্টে বলেন- ‘যা একটু শান্তিতে ছিলাম, ভগবানের সইলো না !’
হৃদয়হীনা গিন্নীর এহেন বাক্য বাণে কাতর জ্যাঠামশাই ভাবেন – ‘আমার গরুই ভালো !’

বছর ঘোরার আগেই নতুন বিপদ- খড়দায় বর্ষাকালে একতলা ডুবে যাওয়া রেগুলার ব্যাপার; ফলে বৃষ্টি এলেই গরু, ছেলেপুলে নিয়ে নাকালের একশেষ ! আবার চেয়েচিন্তে দোতলায় একটা চালা উঠলো প্রথমে; একতলায় জল উঠবো উঠবো করলেই জ্যাঠামশাই আর ছেলেপুলেরা মিলে গরুদের ওপরে তোলেন, একান্ত নিরুপায় হলে- আমার মামাবাড়ির দোতলায় পরিবার পাঠিয়ে, নিজে গরুদের সঙ্গে থাকেন… আর গরুকে ওপরে তোলা সহজ, নামানো যে কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন !

তাঁর মহামান্য গরুরা আবার ভুষি টুষি মোটেই খান না ; মরশুমী ফল, সব্জি, খোল, চিটেগুড়, গাজর, বিট, চাট্টি কচি ঘাস…
শেষ বাজারে যেতেন, সঙ্গে থাকত দুই ছেলে – সস্তায় ফলমূল, সব্জি খরিদ করে, বস্তাবন্দী সওদা ঘাড়ে করে বাপ ছেলেরা যখন ফিরত- জেঠিমা বলতেন, ‘ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে !’
নিজের হাতে খাওয়াতেন, গোয়াল পরিষ্কার করতেন, ছুটির দিন চরাতে নিয়ে যেতেন, সন্ধ্যায় ধুনো দিয়ে রাক্ষুসে মশারীতে গোটা গোয়াল ঘর মুড়ে তবে জ্যাঠামশাইয়ের শান্তি ! দুধ পর্যন্ত কাউকে প্রাণে ধরে খেতে দিতেন না, বাছুর খেয়ে বাঁচলে তবে নাকি সবাই পাবে। জেঠিমা অগত্যা গোয়ালার থেকে বাচ্চাদের জন্য দুধের বন্দোবস্ত করতেন, আর মনের দুঃখে বলতেন- ‘আমার কপাল !’
জীবনে কোনো দিন সপরিবারে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেননি, সবাই গেছে, কর্তা একা বাড়ীতে গরু আগলেছেন…
স্বাভাবিক ভাবেই গরুর নাম শুনলেই হাসিখুশি জেঠিমার মাথায় খুন চেপে যেত।

***

আমার যখন জ্ঞান হয়েছে, জ্যাঠামশাইয়ের গোয়াল আলো করে রয়েছে – ভোলা, সুন্দরী আর সোনামনি। ভোলার কথা কি বলবো ! তারাশঙ্কর কালজয়ী গল্প – ‘কালাপাহাড়’ বোধহয় তাকে দেখেই লেখেছিলেন। সুন্দরী, সোনামনিও বপু আর মেজাজে বরকে পাল্লা দেয়; পাড়ায় তিনজনের বেজায় দুর্নাম, প্রিয় খাদ্য নাকি – লোকের বাড়ির ফুলন্ত গাছ ! বাচ্চা আর সাইকেল দেখলেই ঢুঁশোতে ইচ্ছে করে… মাঠে চরতে পাঠালে হরদম খুঁটো উপড়ে লোকালয়ে গুন্ডামি করে বেড়ায়… খেতের ফসল নষ্ট করে… বুড়ো দয়ালকে পাত্তা দেয় না মোটেই !
প্রথমে জ্যাঠামশাই তেমন গা করেননি, কিন্তু পাড়া কমিটি থেকে নোটিশ পাওয়ার পর, জেঠিমা যখন ভয় দেখালেন- একদিন দুপুরে ঠিক গোহাটার দালালদের খবর দেবেন, তখন জ্যাঠামশাইয়ের টনক নড়লো। রীতিমত ইন্টারভিউ নিয়ে এক ষন্ডা দেখে এক্সপেরিয়েন্সড মুনিশ রাখলেন, সে অল্প দিনের মধ্যেই দিব্যি তিন উপদ্রবকে বাগে এনে ফেললো।

ক্রমে ছেলেরা চাকরিতে ঢুকলো, একমাত্র মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল, আর জ্যাঠামশাই ভলেন্টারী রিটায়ার করে মনের সুখে সোনামণির বাছুর- সুরভীকে নিয়ে সকাল হতে না হতেই এ বাড়ি ও বাড়ি বেড়িয়ে বেড়াতে লাগলেন…

সুরভীর সাদা ধবধবে, নাদুসনুদুস চেহারা- এক্কেবারে ক্যালেন্ডারে শ্রীকৃষ্ণের বেণু বাজিয়ে ধেনু চরানো ছবিতে যেমনটি থাকে; কিন্তু তার মত ত্যাদোড় বাছুর দুনিয়া খুঁজলে আর একটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ ! সাত সকালে আমার মামাবাড়িতে ঢুকেই সুরভী আর তার মনিবের প্রথম কাজ – মাসীমণির সাধের গোলাপ বাগান থেকে সব সেরা দুটি গোলাপ ছেঁড়া; একজন আমিরী কায়দায় নাকে শুঁকে কানে গুঁজবেন, আর অন্য জন কচমচিয়ে খাবেন !
তিন মাস বয়সে বাপকে হারানো মাসীমণি বেজায় আদরের, সে ছেড়ে দেবে কেন ?
– ‘জ্যাঠামশাই, ভালো হবে না কিন্তু! মিছরিকাকুকে বলে আপনার এ বাড়ি আসা বন্ধ করবো, আর আপনার সুরভীকে বরকোদালীকে দিয়ে বকরিদে খাইয়ে দেব !’
মিছরিকাকু হল – মায়েদের সেজোকাকা, দেশের বিখ্যাত এক জেলের জেলার, বড়দার গরুর পাল তাঁর দুচক্ষের বিষ ! ভাইপো-ভাইঝিদের বলে গেছেন- কোনো ঝামেলা করলেই তাঁকে জানাতে, তিনি নাকি সব কটাকে গোশালায় পাঠিয়ে দেবেন, বড়দা সমেত ! বরকোদালী হল মামাবাড়ির মালি, বেচারার আসল নাম পুরাকালে বোধহয় ছিল- বরকত আলী, কিন্তু আমার মায়েদের কল্যাণে সেটা বরকোদালীতে দাঁড়িয়েছে!
রসিক বরকোদালীও লোভী আড়চোখে সুরভীর দিকে চায়… জ্যাঠামশাইকে নাকাল করতে কেউ কম যায় না…
তিনি টপ করে সুরভীকে আড়াল করে, দুঃখী মুখে, কোলেপিঠে করে বড় করা ভাইঝিকে বলেন- ‘অবোলা জীব, না হয় খেয়েইছে তোর গাছের একটা ফুল, তা বলে বরকোদালীর পেটে দিতে হবে ? জানিস, রাজা বাদশারা নিজেদের গরুকে কিলো কিলো গোলাপের পাঁপড়ি খাওয়াতো ? আর, গোবর সার আনতে যাস কখনো !’
– ‘লাগবেনা গোবর সার ! নিজে গোলাপবাগ বানিয়ে খাওয়ান না যত খুশি !’
চাপান উতরের মাঝে সুরভী সিঁড়ি বেয়ে একতলায় দাদার ঘরে ঢোকে চুপচাপ… ছোটভাই রই রই করে ওঠেন – ‘বড়দা ! তোমার বাছুর খাটে উঠেছে !’
– ‘ওভাবে বাছুর বাছুর বলিস কেন রে ? ওর কি নাম নেই ?’ জ্যাঠামশাই সুরভীকে নামাতে ছোটেন, নয় তো ছোটভাই অনর্থ করবে।
এই ট্যালেন্টেড বাছুরটির ভয়ে জেঠিমা সব খাটের পায়ায় অন্তত চারটি করে ইঁট দিয়ে উঁচু করে রাখতেন, নয়তো সে নিচু খাটে দিব্যি উঠে বসে থাকতো!
ডামাডোলের মধ্যেই মায়ের মামারা, মেসো সবাই গুটি গুটি এসে উঠতেন, সেদিনের মত ঝামেলা মুলতুবি রেখে, সুরভীকে গেটের সঙ্গে বেঁধে জ্যাঠামশাই চায়ের আড্ডায় মেতে উঠতেন, আর মাসীমণি বসে বসে তাকে মিছরি আর পর্লেজি বিস্কুট খাওয়াতো … গলকম্বলে হাত বুলোত…

See Also
Dhiraj Da

ক্রমে সুরভী বড় হল, মাসীমণির বিয়ে হয়ে গেল… নিত্যদিনের খুনসুটি আর হয়না… সবাই আসেন, চা খেতে খেতে খানিক গল্প করে বাজারের পথ ধরেন… জ্যাঠামশাই বুক দিয়ে- শ্বশুর ঘর করতে যাওয়া ভাইঝির গোলাপ বাগান আগলান… ছুটিছাটায় মেয়েরা আসে, আবার সুন্দর সুন্দর ছাপা শাড়ী পরে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায়… পুরনো দিন যেন ফিরে আসে…
সবাই মিলে সুরভীকে দেখতে যাই… জ্যাঠামশাইয়ে বিরাট গোয়াল এখন খাঁ খাঁ করে, একপাশে একা সুরভী… ভোলা, সোনামণি, সুন্দরী কেউ আর নেই… সুরভীর বাচ্চাকে দান করে দিয়েছেন বন্ধুকে, আগের মত যত্ন করতে পারেন না, ছেলেরা বিদেশে…
সবাই বলে- জ্যাঠামশাই অবশেষে বুড়ো হলেন !
তবে জেঠিমা মহাখুশি, এতদিনে দুজনে নিরুপদ্রব একটু সময় কাটাতে পারেন একসঙ্গে…

একদিন রাতে, মশারির ভেতর সুরভীকে ঢুকিয়ে এসে সেই যে শুলেন, জ্যাঠামশাই আর উঠলেন না…
জেঠিমা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন, কারো সাথে কথা কন না, কাঁদেন না… মুখে জলটুকু পর্যন্ত দিতে চান না… ছেলেপুলের মুখ গম্ভীর হয় – মাও কি তবে চললেন ?
বড় বউ বলে – ‘সুরভীও কিছু মুখে দিচ্ছে না, খালি কাঁদছে, ভালো বুঝছি না !’
কানে যেতেই জেঠিমা উঠে বসেন, যে গরুর ত্রিসীমানায় কোনো দিন যাননি, সেদিন – নিজের জন্য কেটে রাখা ফল হাতে তার কাছে যান, মুখের সামনে ধরেন…
যে গরুকে শত সাধ্য সাধনায়ও কিচ্ছুটি খাওয়ানো যাচ্ছিল না, সে জেঠিমার হাত থেকে পেয়ারা খায়…
কর্তার একান্ত স্নেহের পোষ্যর গলা জড়িয়ে গিন্নী হুহু করে কেঁদে ওঠেন… পরম মমতায় তাঁর মাথা, মুখ চেটে দিতে থাকে সুরভী…
পুরনো বন্ধন হারিয়ে নতুন বন্ধনে বাঁধা পড়লেন মায়ের সদা হাস্যময়ী জ্যাঠাইমা…

 

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
1
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top