Now Reading
জামাইষষ্ঠী, সেকাল-একাল

জামাইষষ্ঠী, সেকাল-একাল

Avatar photo
জামাইষষ্ঠী, সেকাল-একাল

জামাই ষষ্ঠী নিয়ে বাঙালির আবেগ ভয়ংকর। ট্রমে বাসে ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে ফুলবাবু সেজে জামাইরা, শ্বশুর বাড়ি যান। এই উৎসব নিয়েই এক মজার প্রবন্ধ রাজকুমার মুখার্জির কলমে।

আজ জামাইষষ্ঠী । বাঙালির ঘরে ঘরে একটা উৎসবের আয়োজন। মেয়ে জামাই আসবে, হই হুল্লোড় হবে। যে মেয়ে বিয়ের আগে জল গড়িয়ে খেত না, সে সকালে এসেই মায়ের সঙ্গে রান্নায় সাহায্য করবে। আহা।

এটা সামগ্রিক চিত্র। বাবু, চিত্র এখন বদলেছে। গতকাল আমি বাজারে গেছিলাম। রিটায়ার্ড লোক, পেনশন নেই, একটু কোথায় সস্তায় পাওয়া যায়, তাই খুঁজি। আমাদের বাজারের গোপাল, মাছ বেচে- আমায় বলল “আজ মাছ নিয়ে যান, কাল থেকে বসবো না। আমি বললাম “সে কি রে? কোথায় যাবি?” গোপাল বললো “শ্বশুর বাড়ি, কাল জামাই ষষ্ঠী, শনিবার ফিরবো।” আমার দুঃখ লাগলো গোপালের শ্বশুরের কথা ভেবে। তিন চারদিন জামাইকে খাতির যত্ন করতে হবে। বেচারীর পকেট হবে ফাঁকা। শুধু তো জামাই নয়, জামাইয়ের নাম করে বাড়ির সবাই খাবে। শাশুড়ি বেচারির রান্না করে করে এই গরমে সিদ্ধ হতে হবে। মেয়ে জামাই বলে কথা।
পঞ্চাশ বছর আগের চিত্রটা একবার কল্পনা করুন। চুনোট করা ধুতি, পাঞ্জাবি পরে ফুলতোলা আসনে বসে জামাই দশ পদে গলদঘর্ম হয়ে দুপুরের খাওয়া সারছে। শাশুড়ির পাশে বসে তালপাতার বাতাস করছে। মাঝে মাঝে বলছে “বাবা তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না।” ততক্ষণে জামাই দু পিস কাতলা, গোটা দুয়েক গলদা সাঁটিয়ে ইলিশের দিকে হাত বাড়িয়েছে। ডাগ আউটে তখনো পাঁঠার মাংস, দই, সন্দেশ, রসগোল্লা-ব্যাট করার জন্য প্রস্তুত।
শালিকার দল অকারণে হি হি করে হাসছে, মশকরা করছে। গল্পের করুণ নায়ক- রিটায়ার্ড শ্বশুর, বাইরের দালানে বসে ভাবছে জামাই মেয়ে কি কালকেও থাকবে! তাহলে আর এক প্রস্থ খরচ। এত খরচ সামলাবো কি করে? মনে মনে গিন্নির ওপর গজ গজ করছেন। সব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি। গলদা, ইলিশ, পাঁঠার মাংস-আমার যেন ট্যাঁকশাল আছে। তোমার বাপ, জামাই ষষ্ঠীতে, আমায় কি খাওয়াতো? এরপর জামাইকে কাপড় দাও, মেয়েকে কাপড় দাও, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তত্ত্ব পাঠাও, গুষ্টিসুদ্ধ লোককে শুধু দাও আর দাও।
চব্যচোষ্য খেয়ে জামাই বাবাজীবন দিবা নিদ্রা দেবেন। বিকেল গড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে আম, কাঁঠাল, লিচু। মেয়ের বিয়ে দিয়ে তো মহা ফ্যাসাদ! জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে, জামাই এক মাস আগে থেকে এই দিন অফিসে ছুটি নিয়ে বসে আছে। মহা সেয়ানা। এক হাঁড়ি মিষ্টিতে কেল্লাফতে। সকালে এসে সেই হাঁড়ি শাশুড়ির হাতে দিয়ে প্রণাম সেরে-ব্যাস। এবার শ্বশুরের ঘাড় ভেঙে মিষ্টির দাম উসুল করে তবে বাড়ি ফিরবে। অন্যদিন বুড়িটা রোজ কত কথা বলে, মুখ ঝামটা দেয়, “তোমাদের পোড়া সংসারে হাঁড়ি ঠেলতে ঠেলতে আমার হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়ে গেল।” আজকে দেখো, সব হাসিমুখে করবে। একেই বলে কপাল।
এবার বলি এ যুগের জামাই ষষ্ঠী। এযুগে মা ষষ্ঠীর কৃপা নেই, না লোকে কৃপা চায় না, সে বিচারের ভার আপনাদের। সবার একটি বা দুটি। যাদের দুটি তাদের বেশির ভাগের প্রথম সন্তান মেয়ে। ছেলের আশায় আবার। যদি ছেলে হলো, ভালো। মেয়ে হলে আর নয়-ইতি। তাই শ্যালিকাদের ভিড় নেই। প্রায় সব শ্বশুর এবং শাশুড়ি চাকরিরত এবং চাকরিরতা। সময় কম, জামাই আরো ব্যস্ত। সরকারি চাকুরে জামাই ‘যারা কাজ করব না বেতন বাড়াও’ দাবি তুলে কাজের ক্ষতি করে, সেসব জামাই ছাড়া, বেশিরভাগ জামাই ভীষণ ব্যস্ত। অতএব জামাইষষ্ঠী, না আজ নয়, সামনের রবিবার বা কোন ছুটির দিন। শাশুড়ি ঠাকুরণ রেঁধেবেড়ে খাওয়াবেন, সে গুড়ে বালি। হাইটেক শ্বশুর শাশুড়ি। পাঁচতারা হোটেলে মেয়ে জামাইকে নিয়ে লাঞ্চ অথবা ডিনারে যাবেন। সেলফি হবে, স্ট্যাটাস আপডেট হবে, ফেসবুকে পোস্ট হবে, দশটা লাইক বিশটা কমেন্ট হবে। কেউ লিখবেন ‘এনজয়’ কেউ আবার বুড়ো আঙ্গুলের ছবি পাঠিয়ে কি বোঝাবেন – বোঝা দায়। এই বুড়ো আঙ্গুলের দুটো অর্থ। এক, দারুন ব্যাপার। দুই, তুই খাচ্ছিস খা, আমার কাঁচকলা।
একটু খোঁজখবর করে দেখুন নামিদামি রেস্তোরাঁ গুলো জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে কিরকম স্লোগান দিচ্ছে! যেন আপনার জামাইকে খাওয়াতে পারলে তাদেরই আনন্দ। ‘এথনিক বেঙ্গলি কুইজিন। শুক্তো দিয়ে শুরু, বেক্ড রসগোল্লা দিয়ে শেষ।’ একশ’ বিশ জর্দা দিয়ে পানটাই বা বাদ রাখলি কেন বাপ? কি আদিখ্যেতা! রেস্তোরাঁয় বসে জামাইকে শাশুড়ি ফাস্ট ট্রাকের ঘড়ি গিফট করবে, জামাই এখন ধুতি পরেনা, জিন্স আর হাফপ্যান্ট। জামাইকে হাফপ্যান্ট দেয়া – সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার! জামাই শাশুড়িকে গিফট দেবে। না না শাড়ি নয়। শাশুড়ির আলমারি খুললে শাড়ি আলমারির তাক থেকে লাফিয়ে গায়ে এসে পড়বে। শাশুড়ির জন্য বিদেশী লিপস্টিক, আইলাইনার। শ্বশুরের কপালে কি কিছু জুটবে না? অবশ্যই জুটবে। রেস্তোরাঁর বিল মেটানোর পর, রেস্তোরা থেকে দশ টাকা দামের বলপেন রঙীন কাগজে মোড়া (যদি দেয়)। ওই বলপেন বুক পকেটে গুঁজে, আলেকজান্ডারের বিশ্ব জয়ের হাসি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাজার হলে চলবেনা। বাড়ি ফেরার পথে বেচারী শ্বশুর হিসাব করবে ‘ক্রেডিট কার্ডের বিলটা কবে আসবে, কবে যেন পেমেন্ট করতে হবে?’
আপনারা যাঁরা এতক্ষন ধৈর্য ধরে লেখাটা পড়লেন, তাঁদের ধন্যবাদ। পরিশেষে জানাই আমার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেছেন বহুকাল আগে। জামাইষষ্ঠী আমার নেই। প্রসঙ্গত জানাই, আমার কন্যা সন্তান নেই অতএব খরচ হবার বালাই নেই। তবে একটা ভালো, আপনারা আমায় চেনেন না বা কোথায় থাকি জানেন না। না হলে হয়তো এই লেখা পড়ে, রাগের চোটে, ঢিল ছুঁড়ে আমার বাড়ির যে দু-চারটে আস্ত কাঁচ এখনও আছে, ভাঙতে পিছপা হতেন না ।
What's Your Reaction?
Excited
12
Happy
8
In Love
2
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (2)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top