জনপদকল্যানী



Oli is an avid reader who channels her creatvity through…
পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসার নাম পতিতাবৃত্তি।লোকমুখে যার অনেক বিচিত্র নাম আছে – গণিকাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, দেহব্যবসা ইত্যাদি। আমাদের সমাজে পতিতা, গণিকা, বেশ্যা নানান নামে পরিচিত। তাদের ইতিহাস নিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হয়েছে অলি সেনের কলমে।
প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ
ভারতবর্ষের প্রাচীন কোন এক নগর। কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ যে কোনও নাম হতে পারে। সায়ংকাল ধীরে ধীরে রাত্রির দিকে পা বাড়িয়েছে, আকাশের গায়ে একটি দুটি করে নক্ষত্র স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ… নগরীর মধ্যস্থলে যেখানে বাজার এলাকা অতিক্রম করে মদিরালয় গুলি শুরু হয়েছে সেখানে নগর বিলাসিনী দের গৃহ। রাত্রি যতো গভীর হয় এইসব অঞ্চলে বিলাসী পুরুষদের গতায়াত ততো বাড়ে। এখানে কারোর কোনো ত্বরা নেই – জীবন যাত্রা অলস মন্থর।
মদিরাগৃহের আশেপাশে কোথাও পানের দোকান, কোথাওবা ফুলবিক্রেতার ক্ষুদ্র বিপনী। নবমল্লিকা, জাতি, যুথী,চম্পা, কুরুবকে মালাকরের স্থালী উপছে পড়ছে। পল্লীর মধ্যস্থলে সুউচ্চ অট্টালিকাটিতে চতুঃষষ্টিকলায় পারদর্শিনী অলোকসামান্যা নগরনটীর বাস। তিনি স্বয়ং রাজানুগৃহিতা। কুঙ্কুম, চন্দন,ইঙ্গুদী তৈলে সান্ধ্য স্নান সমাপন করে তিনি অপেক্ষা করছেন।আজ তাঁর গৃহে সমাপানক। স্বয়ং রাজা আজ তাঁর অতিথি। অন্য অন্য রাজ পুরুষরাও আসবেন।তাই তাঁর প্রাসাদ তোরণে আজ দীপোৎসব।
তোরণ পালিকারা পুষ্পমাল্য, সুগন্ধী নিয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ সুশিক্ষিতা ব্রজয়িত্রী এবং রুপদাসীরা কেয়ুর কিঙ্কিনী মঞ্জির শিঞ্জনে অপরূপ সম্মোহন সৃষ্টি করে অভ্যর্থনা করছে সম্মানিত অতিথিদের। গৃহের অভ্যন্তরে বিশুদ্ধ নৃত্যের তালে তালে মৃদঙ্গ- সুষীরের যুগলবন্দিতে অপ্সরা লোকের ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আর যাঁর গৃহে এতো আয়োজন তিনি সর্ব শাস্ত্রে সুপণ্ডিতা, গুণবতী, সাধারণের অগম্যা জনপদকল্যাণী এই রাজ্যের অহঙ্কার। তিনি নগরশোভিনী, নগরলক্ষ্মী। কিন্তু এসবের ওপরেও একটি কথা আছে। যে কথা আপাত প্রচ্ছন্ন, কিন্তু বাস্তবে সর্বজনবিদিত।কথাটি হলো ‘ ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি ‘। অর্থাৎ , নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়-। তাহলে ‘ নগরশোভিনী’ ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেননা নিশ্চয়ই।
সেকালে নগরশোভিনী বা জনপদকল্যাণী নামের আড়ালে যে নারীরা ছিলেন তাদের স্বাধীনতা ঠিক কতটা ছিলো বা কি কি অধিকার তারা পেয়েছিলেন সেটা নিয়ে কথা বলার আগে সার্বিক ভাবে তখন নারীর অবস্থান কেমন ছিল সেইটা জানা দরকার।
এই সূত্রে একটা কথা মনে এলো।’ভার্যা'(বিবাহিতাস্ত্রী) এবং ‘ ভৃত্য’ এই দুটি শব্দই এসেছে ‘ ভৃ ‘ ধাতু থেকে। যার অর্থ হলো ভরণ করা। খাদির গৃহ্যসূত্রে স্বামীকে বলা হয়েছে, আহারের পর স্ত্রী কে উচ্ছিষ্ট টি দিতে(‘ভুক্তোচ্ছিষ্টং উবেব দদ্যাৎ’ ১:৪:১১)। এই স্পষ্ট উক্তির জন্য কোনও ভাষ্যের প্রয়োজন হয় না বোধহয়।
অথচ ঋক্ বৈদিক যুগে নারীর উপনয়ন ও অধ্যয়নের অধিকার ছিলো।তারা যুদ্ধেও যেতেন। ক্রমে আর্যরা যখন অনার্য পত্নী গ্রহণ করতে শুরু করলেন তখন থেকেই তাদের উপনয়ন ও শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলো। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম ই। ধীরে ধীরে নারীর নির্বাসন হচ্ছিল অন্তঃপুরে।
মোটামুটি ভাবে খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে পরবর্তী দেড় হাজার বছর যতো শাস্ত্র রচনা হয়েছিল তাতে নারীকে সমস্তরকম সম্পত্তির অধিকার, এমনকী নিজের দেহের ওপর অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। সেসময় শাস্ত্রই ছিল সংবিধান। অতএব নারী পরিণত হল ভোগের সামগ্রী তে। তাকে বন্ধক রাখা যেত, ক্রয়- বিক্রয় করা যেত, যৌতুক হিসেবে বা যজ্ঞের দক্ষিণাস্বরূপ কিংবা অতিথিকে উপহার জ্ঞানে দান ও করা যেতো।
এই দান করা নারীদের কয়েকজন কে গ্রহনকর্তা ভোগ করতেন, বাকিরা হস্তান্তর বা বিক্রয় হয়ে যেতেন। তারপর জীবনের নানা গলিপথ ঘুরে এরা অনেকেই হাজির হতেন বেশ্যালয়ে। তাছাড়া পরিত্যাক্তা স্ত্রী, ধর্ষিতা কুমারী বা সধবা, বিধবা নারী অনেকক্ষেত্রে এদেরও শেষ গন্তব্য ছিলো গণিকালয় গুলি।
দন্ডীর ‘দশকুমার চরিত’, ক্ষেমেন্দ্রের ‘সময় মাতৃকা’, ব্যাৎসায়নের’ কামসুত্র’, কৌটিল্যের’ অর্থশাস্ত্র’, দামোদর গুপ্তের ‘ কুট্টনীমতম্’ সেযুগের জনপদবধূ দের কথা বলে। ‘জনপদবধূ ‘… শব্দটা কেমন অদ্ভুত না? একজন মাত্র নারী সে কিনা একটা গোটা জনপদের,একটা অঞ্চলের বধূ! কোনো একজনের নয়। আপাত নিরীহ এই শব্দটা আসলে যে কতটা ভয়ঙ্কর!…
রামায়ণ, মহাভারত, কুমারসম্ভব, রঘুবংশে বিলাসের উপকরণ হিসেবে বহুবার নারীকে দেখা যায়।অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিতপক্ষের নারীদের জয়লব্ধ অন্যান্য সম্পদের মতোই নিয়ে এসেছিলেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম এর দ্বিতীয় অঙ্কে দুষ্যন্তের মৃগয়া সহচারীনি যবনীদের কথা পাওয়া যায়। প্রাচীন সাহিত্যে এরকম দৃষ্টান্ত অজস্র।
ঋক্, অথর্ব ও যজুর্বেদে এবং পরবর্তী সময় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে গণিকা শব্দের বেশ কিছু প্রতিশব্দ মেলে। হস্রা, অগ্রূ, পুংশ্চলী, ব্রজয়িত্রী। মহাকাব্য গুলিতে স্বৈরিণী, বারাঙ্গনা, স্বতন্ত্রা ও স্বাধীনযৌবনার নাম পাই। বিনয়পিটক এ একটি শব্দ পাওয়া যায় -‘মুহুত্তিয়া ‘ অর্থাৎ মুহূর্তিকা, যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী।…
গণিকা যখন গণিকালয়ে বাস করত তখন রাষ্ট্র তার শিক্ষার ব্যয়বহন করত।তার আয় থেকে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় হত এবং কৌটিল্য বার্ধক্যে তাকে কিছু বৃত্তি দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব ও অধিকার দুইই তার ছিল।
গণিকার পরের স্তরে ছিলো ‘ রূপাজীবা’। শিক্ষা দীক্ষা রূপ যৌবন অর্থ ও সামাজিক প্রতিপত্তি তে তারা ছিল গণিকার নীচে। তাদের শিক্ষার দায় ছিলো তাদের নিজের,বা তাদের মায়ের অথবা তাদের গ্রাহকের। এছাড়া ছিলো ‘অবরুদ্ধা ‘ অর্থাৎ রক্ষিতা।তার সমস্ত দায়িত্ব ছিল তার পৃষ্ঠপোষকের। এদের নীচে ছিলো নানারকম বৃত্তিধারিণী। যেমন সৈরিন্ধ্রী, শিল্পকারিকা, কুম্ভদাসী, রূপদাসী,নটী, ভঞ্জিকা ইত্যাদি।এরা রাজার বাড়িতে বা কোনো ধনীগৃহে নিজের শিক্ষা অনুসারে জীবিকা নির্বাহ করত। এরা কিন্তু প্রত্যেকেই গৃহস্বামীর ভোগ্য ছিলো। মনে পড়ে মহাভারতের অজ্ঞাতবাস পর্বে পাঞ্চালী বিরাট রাজার রানী সুদেষ্ণার কাছে সৈরিন্ধ্রীর পরিচয়ে ছিলেন।…স্পষ্টই বোঝা যায় গণিকারা ছিলেন ঐশ্বর্যের পরিচায়ক এবং তাদের সংখ্যাও থাকত গৃহস্বামীর সম্পদের অনুপাতে।এদের বাইরে ছিল রূপহীনা, বিগতযৌবনা, অর্ধ শিক্ষিত বৃহৎ একটি রূপোপজীবিনীর দল। ন্ত্রসাহিত্যে, বিশেষ করে মহানির্বাণতন্ত্রে বারাঙ্গনা দের পাঁচটি ভাগ দেখানো হয়েছে।
প্রথম: রাজবেশ্যা– এরা রাজান্তপুরেই থাকতেন।এদের অবাধ চলাফেরায় দৃষ্টি রাখত গুপ্তচর,যামিক রক্ষী ও নর্তকীরা।
দ্বিতীয়: নগরবেশ্যা – এদের বসবাস ছিলো নগরের একাংশে। রাজ্যের প্রমোদভ্রমণ গুলিতে এরা অংশ নিত।
তৃতীয়: গুপ্তবেশ্যা – ভদ্র পরিবারের নারীরা কখনও কখনও গোপনে এই পেশায় যুক্ত থেকে অন্নসংস্থান করত।তাদের স্বামীদের বলা হত জায়াজীব।
‘অভিধানরত্নমালা’ য় এক শ্রেণীর ‘জায়াজীব’ নটের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চতুর্থ: দেববেশ্যা বা দেবদাসী– যারা বিগ্রহপূজারীদের আসঙ্গলিপ্সা চরিতার্থ করতে বাধ্য হতেন। কালিদাসের সময় উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে এরা ছিলেন। হিউয়েনসাঙ এর বর্ণনা আর নানান ঐতিহাসিক শিলালেখ দেবদাসীদের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়।বস্তুত দেবতার নামে যত অন্যায় আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে তার চূড়ান্ত হয়েছে দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে,নারীর অবমাননা। দেবদাসীদেরও নানা শ্রেণী বিভাগ ছিল। কিভাবে এবং সমাজের কোন অংশ থেকে এদের আনা হত তার একটা ইঙ্গিতও এই শ্রেণী বিভাজনের মধ্যে পাওয়া যায়।
১: দত্তা- কোন পূণ্যলোভী গৃহস্থ স্বেচ্ছায় মন্দিরে নিজ কন্যা দান করলে সে হত ‘দত্তা ‘দেবদাসী।(কবি জয়দেব পত্নী পদ্মাবতী ছিলেন জগন্নাথ মন্দিরের দত্তা দেবদাসী)।
২: হৃতা – যেসব মেয়েকে হরণ করে নিয়ে এসে মন্দিরে দান করা হত।
৩: বিক্রীতা – মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কন্যা বিক্রয় করলে সে হত বিক্রীতা দেবদাসী।
৪: ভৃত্যা – কোন নারী স্বেচ্ছায় মন্দিরের কাজে আত্ম নিবেদন করলে সে হত ভৃত্যা।
৫: ভক্তা- স্বেচ্ছায় আত্ম বিক্রয়কারী সন্ন্যাসিনী।
৬: অলংকারা – কলাবিদ্যা শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর যে নারীকে দেব মন্দিরে অর্পণ করা হত।অনেক সময় রাজ দুহিতারাও এই কাজে নিবেদিত হতেন।
৭: গোপিকা/ রুদ্র গণিকা – এরা ছিলেন নির্দিষ্ট সময়ে নৃত্য- গীত করার জন্য বেতনভোগিনী দেবদাসী সম্প্রদায়।
বাংলাদেশের দেবদাসীদের প্রসঙ্গ প্রথম পাওয়া যায় অষ্টমশতকে কল্হনের ‘ রাজতরঙ্গিনী ‘ গ্রন্থে। অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় এর মতে পাল আমলে এদেশে দেবদাসী প্রথার অতটাও বিস্তার ছিলনা- পরে সেনবর্মন আমলে দক্ষিণী প্রভাবে এর প্রসার ঘটে। তবে পাল যুগেও বাংলায় দেবদাসী প্রথার অনেক বর্ণনা মেলে। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘ রাম চরিত ‘ কাব্যে মন্দির বেশ্যাদের রূপ লাবণ্যের দীর্ঘ বর্ণনা আছে। গুপ্ত যুগে মহাকবি কালিদাসের ‘ মেঘদূত ‘ কাব্যেও এদের বর্ণনা পাওয়া যায়-
‘পাদন্যাসৈঃ ক্কণিতরশণাস্তত্র লীলাবধূতৈঃ।
রত্নচ্ছায়াখচিতবলিভিশ্চামরৈঃ ক্লান্তহস্তাঃ।…’
(পূর্ব মেঘ)
পঞ্চম: ব্রহ্মবেশ্যা/ তীর্থগা – তীর্থ ক্ষেত্রে প্রচুর জন সমাগমের কারনে এই নারীরা অবাধে তাদের বৃত্তি অনুসরণ করতেন। ব্যস এর ‘ কাশীখন্ড’ এ কলাবতী নামের এমন এক নৃত্যগীতনিপুনা সুপণ্ডিতা নর্তকীর কথা পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে ‘ প্রব্রাজিকা ‘ বা ‘ ভিক্ষুকী’ নামের এক শ্রেণীর সন্ন্যাসিনীর উল্লেখ মেলে। এঁরা কেউ কেউ কামকলায় পারঙ্গম ছিলেন। বহুক্ষেত্রে এঁরা কুট্টনীবৃত্তি অবলম্বন করতেন। এঁদের কুটির তখন প্রেমিকদের অভিসার ক্ষেত্রে পরিণত হত।কৌটিল্যের ‘ অর্থশাস্ত্র ‘ এবং ভবভূতির ‘ মালতী মাধব’ এ এঁদের কথা পাওয়া যায়।
মনুসংহিতায় বলা হয়েছিল,নারীর পক্ষে বিবাহই উপনয়ন, পতিসেবা বেদাধ্যয়ন এবং পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস (২:৬৭)। ফলে সাধারণ ভাবেই স্বল্প শিক্ষিত বা প্রায় অশিক্ষিত স্ত্রী কখনো স্বামীর মানসিক সঙ্গী হয়ে উঠতে পারতনা। অন্যদিকে গণিকার শিক্ষা তালিকা ছিল প্রকাণ্ড। সুতরাং জাপানের ‘গেইশা ‘ বা ফরাসিদের ‘ সালঁ ‘ গুলির অধিকত্রী দের মতোই এদের মানসিক উৎকর্ষ পুরুষকে আকর্ষণ করত।
বাস্তবিক গণিকা বা রুপজীবার পাঠ্যতালিকা সুদীর্ঘ ছিল। জৈনগ্রন্থ ‘ বৃহৎকল্প ‘ জানাচ্ছে এদের শিখতে হত লেখা, গণিত, কাব্য রচনা( সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ), সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, দ্যুতক্রীড়া, অক্ষক্রীড়া, নানারকম শিল্পকলা যেমন- গন্ধযুক্তি(সুগন্ধী তৈরী), সজ্জা, অলঙ্করণ, অলঙ্কার নির্মাণ, এছাড়া হস্তী বিদ্যা, অশ্ববিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা, বিষ নির্ণয় ও তার প্রতিবিধান, এমনকী স্থাপত্য, শিবির নির্মাণ,সেনা সন্নিবেশ, যুদ্ধ বিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, নিমিত্ত নিদান ইত্যাদি সর্বমোট বাহাত্তর টি বিষয়। ফলে সুশিক্ষিত, বিদ্বান, রুচিশীল পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে ওঠার সবরকম শিক্ষাই তারা পেতেন। বলাইবাহুল্য রাষ্ট্রেরও এতে স্বার্থ ছিল।
প্রথমতঃ রাষ্ট্র গণিকার কাছে উচ্চহারে রাজস্ব পেত।
দ্বিতীয়তঃ গনিকারা রাষ্ট্রের চরের কাজও করত।
শিক্ষা- দীক্ষা- রুচির উৎকর্ষে শত্রুপক্ষের পদস্থ ব্যক্তিকে মোহমুগ্ধ করে গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করা এদের পক্ষে অসহজ ছিলনা।
ব্যৎসয়নের ‘ কামসূত্র’ এবং কাত্যায়নের ‘ ভ্রাতৃকসূত্র’ তে গণিকা সঙ্ঘের কথাও পাই। ‘বিষ্ণুস্মৃতি’ ও ‘সময়প্রদীপ’ গ্রন্থের মতে অনুকূলযাত্রার জন্য গণিকা দর্শন পরম শুভকর। শস্যের দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণে যৌনতার প্রতীক এই গণিকাদের গৃহ মৃত্তিকা ছিল অপরিহার্য। ‘মৎস্যপুরাণ’ গণিকাদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ে অর্থাৎ বেশ্যাধর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। কৌটিল্য গণিকালয় গুলিকে তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ‘অর্থশাস্ত্র’ তে বিগতযৌবনা রূপোপজীবিনীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার নির্দেশও ছিলো। তার অর্থ কি এই বৃত্তি তখন আইন সঙ্গত করা হয়েছিল?
বিষ্ণুপুরাণ (৭০অধ্যায়)গণিকার জন্য স্বতন্ত্র এক ব্রতেরও বিধান দেয়। এর নাম ‘ অনঙ্গব্রত ‘। তার বৃত্তি যেনো সাফল্য পায় এই ছিল ব্রতের উদ্দেশ্য।
অথচ সমাজে গণিকা গমনকে পাপ বলা হয়েছে, এবং তার জন্য ‘ প্রাজাপত্য ‘ প্রায়শ্চিত্তের বিধান ও ছিলো। অপরপক্ষে গণিকার উপার্জনের একটা বড়ো অংশ রাষ্ট্র ভোগ করতো, তাদের দান গ্রহণ করতেও কারোর কোনও দ্বিধা ছিলনা- জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে গণিকাদের কূপ, চৈত্য, উদ্যান, মঠ, পুষ্করিণী দানের অজস্র উল্লেখ আছে। অথচ গণিকাপল্লির বাসিন্দারা ছিল অবজ্ঞা আর ঘৃণার পাত্র!
এই পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন স্ববিরোধী …
আসলে সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা কোনোদিনই স্থির করে উঠতেই পারেননি গণিকাদের প্রতি তাদের মনোভাব ঠিক কি হওয়া উচিৎ। ‘কামসূত্রে’ তাদের স্পষ্টই ‘ পণ্যদ্রব্য’ বলা হয়েছে। একটা মানুষের কতটা অবমাননা ঘটছে এতে, অথচ কোনো প্রাচীন সাহিত্যে এই অপমানের উল্লেখ মাত্র নেই! আসলে এটা যে সমাজ ব্যবস্থার একটা কলঙ্ক সেই বোধটাই যেনো অনুপস্থিত!
একদিকে কামশাস্ত্রে গণিকাকে নিজের প্রার্থীকে প্রতারণা করে বা যতদূর সম্ভব বঞ্চিত করে অর্থ সংগ্রহের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সেই নির্দেশ মান্য করলে তাকে নিন্দা করা হচ্ছে। অদ্ভুত এই দ্বিচারিতা! লক্ষণীয়, কামশাস্ত্র কিন্তু কোনো নারীর রচনা নয়।
সমাজে যার কোনো মূল্য নেই, আত্মীয় বন্ধু নেই, আইনী সহায়তা নেই, (পুঁথিগত ভাবে থাকলেও বাস্তবে নেই) নিজের স্বার্থরক্ষা, ভবিষ্যত চিন্তা, গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টা সে করবেনা?!
রোগে, শোকে, বার্ধক্যে নিরাপত্তার কোনও আশ্রয়ই তাদের ছিলনা। সমাজ যেখানে নিজের স্বার্থে অসুস্থ, অপমানজনক এই বৃত্তির জন্ম দেয় এবং তা টিকিয়ে রাখে সেখানে তাদের প্রতি কিছু কিছু দায়বদ্ধতা সমাজেরও থাকে বৈকি।
সমাজ কিন্তু সেই দ্বায়বদ্ধতা স্বীকার করেনি, উপরন্তু গণিকার তথাকথিত পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই দেহবিক্রয় চক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে।
গণিকার মা যেমন ছিলেন গণিকালয়ের কর্তৃত্বে, তার ভগিনী তেমন ছিল ‘ প্রতিগণিকা ‘ অর্থাৎ গণিকার বিকল্প। গণিকার ভাই কে অভিনেতা বা সঙ্গীত বিদ্যায় পারদর্শী হতে হতো। রাষ্ট্র অবশ্য তার শিক্ষার দায়িত্ব নিত কিন্তু গণিকার থেকেও তার মুক্তির মূল্য ছিল অনেক বেশী।
গণিকা পুত্রদের বলা হত বন্ধুল। ‘মৃচ্ছকটিক ‘ নাটকে তাদের আত্মপরিচয় বড় করুণ – ‘ পরের গৃহে লালিত, পরের অন্নে পুষ্ট, পরপুরুষের দ্বারা পর নারীতে জন্ম আমাদের ‘।… গণিকা কন্যাদের সংজ্ঞাও তো অন্য কিছু ছিলনা।…
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিকেই তাদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র যেন সর্বদাই তৎপর ছিল।যদিও প্রথম শ্রেণীর বারমুখ্যাদের পারিশ্রমিক ছিলো অত্যন্ত উচ্চহারের- যেমন বৈশালীর আম্রপালির একরাত্রির দর্শনী ছিল ৫০কাহাপণ( কার্যাপণ =স্বর্ণমুদ্রা), রাজগৃহের শালাবতী প্রতি রাত্রে উপার্জন করতেন ১০০কাহাপণ এবং তার কন্যা সিরিমার মূল্য ছিল ১০০০কাহাপণ। কিন্তু এই উপার্জনের শতকরা ২৫/৩০ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য,তবুও তাদের উপার্জন নেহাৎ অল্প ছিলনা। যদিও বাস্তবে স্থাবর সম্পত্তির উপর তাদের একান্ত অধিকার অনুপস্থিত ছিল। বস্তুত গণিকার যে সম্পত্তিতে অধিকার নেই একথা মহাভারত তার ‘আদি পর্ব ‘,’ উদ্যোগ পর্ব ‘ এবং ‘ সভা পর্বে ‘ আমাদের বারবার করে মনে করিয়ে দেয়। মায়ের মৃত্যুর পর গণিকা কন্যার সেই সম্পত্তি বিক্রয়, দান বা বন্ধক রাখারও কোন উপায় ছিলনা। যুদ্ধ বা রাষ্ট্রের অন্য কোন বিপদকালে বারবনিতা দের অর্ধেক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যেত।
তাদের নিজেদের দেহের উপরেও কোন অধিকার ছিল কি?! ধর্মসূত্রকার গৌতম বলেছিলেন বেশ্যাকে হত্যা করা কোন অপরাধই নয়!(গৌতমধর্মসূত্র ২২:২)
আবার রাজার প্রেরিত প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিলে গণিকার শাস্তি ছিল পাঁচশ পণ দন্ড আর এক হাজার বেত্রাঘাত! যদিও কৌটিল্য তাঁর ‘ অর্থশাস্ত্রে ‘ গণিকার উপর শারীরিক নির্যাতন এবং তাকে প্রকাশ্যে অপমানের দন্ড ধার্য করেছিলেন!
এসব তো গেলো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং দৈহিক অধিকার এর কথা। কিন্তু মন? সেকালের বারবনিতা দের মনের কথার কোনও সন্ধান কি করেছিলেন কেউ? শূদ্রকের ‘ মৃচ্ছকটিক ‘ নাটকের নায়িকা বসন্তসেনা যদিও চারুদত্ত কে সত্যিই ভালোবেসে ছিলেন, কিন্তু নাটকের বাইরে যে বাস্তব জীবন তার খবর পাওয়া কি অতই সহজ ছিল! কথায় বলে ‘পর চিত্ত অন্ধকার’, কে তার সন্ধান রাখে! কিন্তু মহাকাল যাকে আপন হাতে চিরজীবী করে রাখেন তার পক্ষে হারিয়ে যাওয়াওত সহজ নয়।
সেকালের কবিরা এঁদের মনের কোনও সংবাদ রাখতেন কিনা জানা যায়না,তবে ইতিহাস কিন্তু সেই সত্যের সন্ধান রাখে। ছত্তিশগড় জেলার অম্বিকাপুর থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণ- পশ্চিমে একটি শীর্ণ পথ এঁকেবেঁকে রামগড় পর্বতের শীলাকর্কষ রুক্ষতার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এই পর্বতের পদতলে ‘যোগীমারা ‘ গুহার গায়ে খ্রীঃপূঃতৃতীয় শতকের এক লিপির খোঁজ পাওয়া যায়। লিপিটি ‘সুতনূকা ‘ নামের কোন এক দেবদাসীর নামে লেখা।
লিপিটি নিম্নরূপ:
”সুতনূক নাম দেবদশিক্যি
তম্ অকাময়িথ বলনশেয়ে
দেবদিন্নো নাম লূপদখে।…”
‘সুতনূকা নামে দেবদাসী। তাকে কামনা করেছিল বারাণসীর দেবদিন্ন (দেবদত্ত) নামের এক রূপদক্ষ।’
বহুদূর অতীতের এক পরিচয়হীনা দেবদাসীর নাম পাষাণ শিল্পী দেবদত্তের বজ্রসূচিতে স্থির হয়ে রইল চিরকালের মত।
সেকালে দেবদাসীদের বিবাহ হতনা…তারা ছিলো দেবভোগ্যা…রূপদক্ষের কামনা তাই পূর্ণ হয়নি – পূর্ণ হলে মর্মান্তিক গোপন কথা পাষাণ ফলকে উৎকীর্ণ হতনা – দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত সুতনূকাকে নিষ্ফল কামনা করে হৃদয়ের আকুল বেদনাকে পাষাণ গাত্রে লিপিবদ্ধ করে সে কোন্ স্বান্তনা পেতে চেয়েছিল,
কেজানে !…
গ্রন্থঋণ:
প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম খন্ড: সুকুমারী ভট্টাচার্য
প্রসঙ্গ দেবদাসী : আরতি গঙ্গোপাধ্যায়
প্রাচীন ভারতে গণিকা: বৈদ্যনাথ আচার্য
বৌদ্ধযুগে নর্তকী ও বারবনিতা: ডঃ বিমলা চরণ লাহা
What's Your Reaction?

Oli is an avid reader who channels her creatvity through writing. In the past she had been working for the newspaper "Aaj Kaal" as a freelance journalist and her passion for writing still persists.