চিঠিপত্র – ভাগ – ২
Shayak is from Kolkata and like a true Calcuttan is…
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে চিঠি লেখার অভ্যেস মানুষের হারিয়েই যেতে বসেছে। কিন্তু একটা চিঠি শুধু মাত্র অক্ষর বিন্যাস নয়.. থাকে প্রিয় মানুষের ছোঁয়া.. সেই অনুভূতিকেই ছোঁয়ার প্রচেষ্টা সায়ক ঘোষের চিঠিপত্র সিরিজে..দ্বিতীয়ভাগে থাকলো সিরিজের আরো কিছু অংশ..
ভাগ – ২
চিঠিপত্র-৪
প্রিয়,
শুভ যীশু দিবস। অবশ্য চিঠি যদ্দিনে তোমার কাছে পৌঁছবে ততদিনে আপামর ভারতবাসী নতুন বছরের প্রহর গোণা, বলা ভালো নতুন বছরের ফুর্তির প্ল্যান শুরু করে দিয়েছে। হ্যাঁ, ভেবেচিন্তেই লিখেছি ফুর্তি। জানি তুমি আবার ধমকাবে। বলবে পেসিমিস্টিক চিন্তাভাবনা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। কি করবো বলো? আমি তো এরকমই।
এইতো কদিন আগে, ঠিক এক বছর। পাকিস্তানে শয়ে শয়ে শিশুকে নৃশংস ভাবে গুলি করে হত্যা করা হল। লোকজন চোখের জলে নাকের জলে একাকার হল। কদিন বাদেই নিউইয়ার ইভে কেউ কেউ আনন্দে মদ খেল কারন কিছু ভবিষ্যতের জঙ্গি(?) মারা গেছে আর কেউ কেউ দুঃখপ্রকাশ করে মদ খেল। সলিড্যারিটি জানালে আজকাল স্ট্যাটাস বাড়ে। ছেড়ে দাও পাকিস্তান, চেন্নাইতে এতবড় বন্যা হয়ে গেলো সবাই ফেসবুকীয় চোখের জল ঝেড়ে মেতে উঠেছে নতুন বছরের নতুন মোচ্ছবের প্ল্যানে। ওদের কোন বালটা ছেঁড়া গেছে? (হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে রাগের সাথে।) আচ্ছা মানুষের বোধগুলো কি আজকে এতটাই ঠুনকো হয়ে গেছে? নিজেরটুকু ছাড়তে এতো অনিহা? চা বাগানের শ্রমিকগুলো মরছে। মহারাষ্ট্রে এক কৃষক দম্পতি মহাজনের ধার সুদতে না পারায় পরিবার শুদ্ধ জ্যান্ত গায়ে আগুন দিল..কি হয়েছে আমার কে জানে.. কিছুদিন ধরে এক মৃতপ্রায় শ্রমিকের কঙ্কালসার দেহটা স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছি। ভাত খেতে বসলে মাংস পোড়ার গন্ধ পাই.. কোনোদিন পাগল হয়ে যাব!
ইদানিং এই পৃথিবীটাকেই আমার একটা ব্যামো বলে মনে হয়।বয়ে চলেছি আমার শরীরে, আমার মননে। ঘুমের ভেতর বয়ে চলেছে দুঃস্বপ্নের মিছিল। আমাকে যদি কেউ এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে সে একমাত্র তুমি..আর পারছিনা আমি..মাঝে মধ্যে মনে হয় দিনের পর দিন ধুম জ্বরে পড়ে আছি..যার কোনো পথ্য নেই..চিকিৎসা নেই।। তুমিই তো আমার জ্বরের শেষে সূর্যধোয়া ঘর.. এসো প্রিয় মুক্তি দাও। দাও শতাব্দীর ঘুম।
“ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।”
ইতি
সায়ক
চিঠিপত্র-৫
প্রিয়,
নতুন বছরের শুভেচ্ছা। অনেক আদর ভালোবাসা মিশিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি। আগেই লিখতাম। শরীরটা ভালো যাচ্ছিলোনা ক’দিন ধরে। না চিন্তা কোরনা এখন ঠিক আছি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ। সত্যি ক’দিন ধরে বেশ অনিয়ম চলছিল। আজকে সকালে রোদ ঢুকে আমার বালিশ বিছানা চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল আর ঘরে চলছিলো সুমনের গলায় রবীন্দ্রসংগীত। সত্যি তো! আমার মতো সুখী কে আছে? মনে হল তোমায় নতুন বছরের প্রথম চিঠিটা লিখেই ফেলি।
এবছর শীতটা জাঁকিয়ে পড়লনা আমার শহরে। এক মাঘে শীত যায়না প্রবাদটা হয়তো মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। এখনতো দেখি এক পৌষেই শীত পালিয়ে গেল। জানিনা হেমন্তের মতো শীতটাও ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে কিনা! কমলালেবুর গন্ধও পাইনা তেমন শহরের আনাচে কানাচে। এই শীতটা এলেই কেমন ছোটবেলাটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্নান করে রোদে পিঠ দিয়ে অঙ্ক করতে বসতাম। মাঝে মাঝে পিঠের ওপর মার বুনতে থাকা সোয়েটার এসে পড়ত। আর ছিলো কড়াইশুঁটির কচুরি নতুন আলুর আলুর দম। এই একটা সময়ই বাবা হেঁটে হেঁটে শহর চেনাতো, চিড়িয়াখানা থেকে ভিক্টোরিয়া। সার্কাস বসত শীতকালে। ফি বছর বাবা সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেত। সেই সময় থেকেই জোকার দেখে আনন্দ পেতাম..হাসতাম..পরে বুঝেছি জোকার দেখে হাসা যায় না..। এই শীত কালেই বাবা শিখিয়েছিল খেজুরের রস কিরকম তাড়ি হয়ে যায় বেলা বাড়লে..আমার প্রথম ডার্বিও বোধহয় বাবার সাথেই এই শীতকালে..এখন বাবাও নেই ছেলেবেলাও নেই। শুধু মনকেমন রয়ে গেছে। শীতকাল এলেই ফিরতে ইচ্ছে করে আমার ছেলেবেলার কলকাতায়। এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে এই শহরে উত্তুরে হাওয়া আসুক, বিষাদ এবং মনখারাপে। আগুন পোহাক পাড়ার মোড়ে। চায়ের দোকানে আড্ডা জমুক। মায়ের আদর লেগে থাকুক সোয়েটারে। তরুণ কাশ্মীরি চাদরওয়ালা ছেলেটার আগামী পাঁচমাসের গ্র্যাজুয়েশনের কোর্সফিস আর আব্বার ওষুধের খরচ জোগাড় করে দিক আমার শহর.. একটা তরতাজা শীতের সকাল মহাসমারোহে নেমে আসুক এই শহরের অলিতে গলিতে..।। আমার শহরে শীতকালও যে খুব রঙিন..।।
ভালো কথা; তোমার খুব ঠাণ্ডার ধাত। সোয়েটার আর মাফলার ছাড়া বেরিয়োনা। হ্যাঁ, আমিও অবাক হই বছর তিরিশে এসেও এইভাবে প্রেম জমে..।।
-প্রিয়
সায়ক
What's Your Reaction?
Shayak is from Kolkata and like a true Calcuttan is deeply passionate about literature. He is a poet, a writer and a dramatist who believes in contributing to the society with his work.