চতুষ্কোণ
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লেখক নিজের ফেলে আসা জীবনের কিছু ঘটনা কে উপলব্ধি করেছেন। হিন্দু পুরাণ মতে আত্মার বিনাশ হয় না। এক দেহ ছেড়ে অন্য দেহে প্রবেশ করে। এই নিয়ে গল্প ‘চতুষ্কোণ’। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী।
আমি সাত্যকি। সাত্যকি বসু, বয়স বাষট্টি। স্ত্রী এবং এক ছেলে নিয়ে আমার সংসার। আমার স্ত্রী নীলাঞ্জনা, গৃহবধূ। ছেলে ঋতবান, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ভালো চাকরি করে। বছর দুয়েক আগে আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি বসে আছি।
সেদিন সপ্তাহের প্রথম দিন, সোমবার, রাতে আমার খুব বুকে ব্যাথা হয়। চাপটা ক্রমশ বাড়তে থাকে, মনে হচ্ছিলো বুকের ওপর কেউ একশ মণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। চোয়ালে অসহ্য যন্ত্রণা। বাঁ হাতের ভেতর দিয়ে একটা চিনচিন করা ব্যথা সরু হয়ে কাঁধ থেকে কনুই হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘরে যেন কোন হাওয়া নেই। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছি না। তখন বেশ রাত। নীলাঞ্জনা কে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিলাম। পাশের ঘর থেকে ঋতবান ছুটে এলো। আধ ঘন্টার মধ্যে আমি ইএম বাইপাসের ধারে এই হাসপাতালে।
যখন আমায় ভর্তি করানো হচ্ছিলো তখনও চোখ খুলে সব দেখার চেষ্টা করেছি। এমার্জেন্সির বিছানায় শুয়ে সিলিং থেকে নেমে আসা আলোগুলো কি রকম নিভু নিভু লাগছিলো। আমার পাশে আমার স্ত্রী, নীলাঞ্জনা দাঁড়িয়ে আমায় জিজ্ঞেস করছিলো “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?”
হাত দিয়ে অক্সিজেন মাস্কটা সরিয়ে যে কিছু বলবো, সে ক্ষমতাটুকু আমার নেই।
নীলাঞ্জনার কথাগুলো মনে হচ্ছিল যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। চোখের সামনে সিলিং এর আলোটা উজ্জ্বল সাদা থেকে ক্ষীণ হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নীলাঞ্জনা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কি ঠান্ডা হাত। চোখের সামনে একটা বালির ঘূর্ণন। আমার দু’চোখের পাতা খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সব অন্ধকার। হাল্কা হাল্কা শব্দ ভেসে আসছে। কি বলছে, কে বলছে – কিছুই বুঝতে পারছি না। কয়েক মুহূর্ত, তারপর সব অন্ধকার। এক গভীর কালো টানেলের মধ্যে দিয়ে দুরন্ত গতিতে আমি ছুটে চলে যাচ্ছি। টানেলের প্রতিটা বাঁকে মনে হচ্ছে দেয়ালের সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগে যাবে। স্পিড, স্পিড, স্পিড।
(প্রথম কোণ)
এখন আমি শুনতে পাই, বুঝতে চেষ্টা করি। এটা বোধহয় হাসপাতালের বিছানা হবে। চোখ খুলতে পারি না, চোখের পাতাগুলো বড্ড ভারি। কেউ যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। মুখের ভেতর দিয়ে একটা নল গলা দিয়ে নিচে নামানো। জিভ নাড়াতে পারি না সমস্ত শরীর অবশ। হাত পা কিছুই নাড়াতে পারি না। মাথার ভেতর একশ’ ঘোড়ার দাপাদাপি। সময় যেন পিছলে পিছলে চলে যাচ্ছে। হু হু করে পিছিয়ে চলেছে। অনেকটা পুরনো দিনের ভিসিআরে সিনেমা পিছিয়ে বা এগিয়ে নিয়ে যাবার মতন। ছুটে চলা ছবি এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
বিরাট সমুদ্রতট, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মারিনা বিচের পাশে কামরাজার সালাই এর নিয়ন আলো গুলো জ্বলে উঠেছে। আমি একটা বাঁধানো চাতালে বসে সমুদ্রের উপর থেকে উড়ে আসা এরোপ্লেনের আলোর দিকে তাকিয়ে আছি। কেন জানি না মনে হচ্ছে নতুন বার্তা নিয়ে চেন্নাইয়ের বুকে নামছে ওই এরোপ্লেন।
আজ নীলাঞ্জনা ঋতবানের আমার কাছে চেন্নাইয়ে আসার জন্য ট্রেন ধরার কথা ছিল। আয়লার প্রচন্ড ঝড়ে সব লন্ডভন্ড। ট্রেন বাতিল হয়ে গেছে। একটু আগে ফোন করেছিল নীলাঞ্জনা। ঋতবান লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, টিকিটের টাকা ফেরত নেবে। কলকাতার আকাশে যখন দুর্যোগের ঘনঘটা, চেন্নাইয়ের আকাশ তখন শান্ত স্থিতধি। সাগরের নোনা জলের হাওয়া আমার চোখে মুখে লাগছে। চাকরির খাতিরে আমি এখানে একা। কতদিন ঋতবান কে দেখি নি। এবারে ওর বারো ক্লাসের রেজাল্ট বের হবে।
আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। বোতাম টেপা ফোন। স্মার্ট ফোন তখনো বাজার ছেয়ে ফেলেনি। নীলাঞ্জনা।
ফোন ধরে আমি বললাম “হ্যালো”।
ওপাশ থেকে নীলাঞ্জনা বলল “আমাদের টাকা ফেরত নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। দেখি কি পাই, এখানে গাড়ি, বাস প্রায় সব বন্ধ।”
আমি বললাম “তোমরা প্লেনে আসতে পারো না? তাহলে সামনের মাসে চলে এসো। তুমি একবার ঋতবান কে ফোনটা দাও। ওকে বুঝিয়ে বলি।”
ঋতবান ফোন ধরে বললো “বলো বাবা।”
আমি বললাম “তোরা সামনের মাসে এখানে চলে আয়, প্লেনের টিকিট এখন থেকে চেষ্টা করলে একটু সস্তায় পেয়ে যাবি”।
আমি এক মাস ধরে ওদের অপেক্ষায় এখানে বসে আছি। ওদের দেখার জন্য আমার মনটা ভীষণ ছটফট করছে। এতো প্রতীক্ষা, এতো অপেক্ষার কি নিদারুণ পরিণতি। আমার গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। দু চোখের বাঁধ এইবার ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি না, ছেলেদের চোখের জল একদম মানায় না।
ঋতবান বললো “বাবা, সামনের মাসে আমার রেজাল্ট আউট হবে, আমরা যাব কি করে? এরপর কলেজে ভর্তি হতে হবে, জয়েন্টের রেজাল্ট বের হবে! তার চাইতে তুমি এখানে চলে এসো”।
না, আমার যাওয়া হয়নি। পরদিন অফিসে এসে কলকাতার বড় সাহেব কে ফোন করেছিলাম। বললাম “স্যার সামনের মাসের ছেলের হায়ার সেকেন্ডারি রেজাল্ট বের হবে, কলেজে এডমিশন আছে। আমাকে যদি দশ দিনের ছুটি দেন, আমি মেইল করে দিচ্ছি।”
বড় সাহেব বললেন “ছুটি এখন দেওয়া যাবে না। দশ দিন নয়, বড় জোর দু’দিনের ছুটি দিতে পারি।”
আমি বললাম “স্যার চেন্নাই থেকে কলকাতা ট্রেনে যেতেই দু’দিন। যদি শনিবার প্লেনে যাই তবে মঙ্গলবার ফিরে আসতে হবে। মাঝে একদিন পাবো, সোমবার। কি করে সব ম্যানেজ করবো! প্লিজ, একটু কনসিডার করুন স্যার।”
বড় সাহেব বললেন “আপনার যখন এতই দরকার, আপনি আপনার রেজিগনেশনটা মেইল করে দিন, আমি এই উইকেই আপনাকে রিলিজ করে দেবো।”
ফোন রেখে দিলাম। ক’দিন বাদে ঋতবানের ফোন “বাবা, আজ উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি নাইনটি পার্সেন্ট এর উপর পেয়েছি। অংকে একশ তে একশ। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইংরেজি, স্ট্যাটিসটিক্স এ নব্বইয়ের উপর নম্বর। বাংলাতেই একটু কম। আমি বাংলাতেও লেটার আশা করেছিলাম। আমি কিন্তু এবার অংকে অনার্স করবো।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলো।
আমার বুকের মধ্যে আনন্দের জয় ঢাক বাজতে শুরু করলো। বললাম “তোর মাকে একবার ফোনটা দে।”
ঋতবান নীলাঞ্জনা কে ফোনটা দিলো। আমি বললাম “ছেলে তো দারুন রেজাল্ট করেছে, অংক নিয়ে পড়বে বলছে। পড়ুক। যেটা নিয়ে পড়তে চায়, সেটাই পড়ুক। কোন বাধা দিও না। যদি সেন্ট জেভিয়ার্স বা যাদবপুরে চান্স পায়। খুব ভালো হয়।”
নীলাঞ্জনা বললো “আমিও ওকে সেটাই বলেছি। নাও, ওর সঙ্গে একটু কথা বলো”।
ঋতবান ফোন ধরে বললো “বাবা আমি কিন্তু আইএসআই আর প্রেসিডেন্সিতে এডমিশন টেস্ট দেবো”।
আমি বললাম “দিস। তবে প্রেসিডেন্সি তে বড্ড পার্টি কালচার। সেন্ট জেভিয়ার্স কিন্তু খুব ভালো কলেজ, পার্টি পলিটিক্স নেই, লেখাপড়াটা ঠিকঠাক হয়।”
ঋতবান বললো “তুমি কবে আসবে”?
এক বুক হতাশাকে পাথর চাপা দিয়ে বললাম “এখন একটু কাজের চাপ চলছে বাবা, একটু হাল্কা হলেই আমি যাব। ততদিনে তুই কলেজে ভর্তি হয়ে যা।”
আমার ছেলের এমন আনন্দের দিনে, আমি সামিল হতে পারলাম না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো।
প্রথম ফোন করলাম কলকাতায়, অফিসের বড় সাহেব কে “স্যার, আজ হায়ার সেকেন্ডারি রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমার ছেলে নাইনটি পার্সেন্ট এর বেশি পেয়েছে। অংকে একশ তে একশ।”
বড় সাহেব বললেন “কনগ্রাচুলেশন”।
আমি একবারের জন্যও আমার ছুটির কথা বললাম না। জীবনে কখনো না খেলে ময়দান ছাড়েনি। আজও ছাড়বো না। হেরে যেতে আমি শিখি নি।
জনে জনে লোকের কাছে বলেছি ‘এ বছর আমার ছেলে হায়ার সেকেন্ডারি তে নাইনটি পার্সেন্ট এর বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। অংকে একশ তে একশ।’ প্রতিবার বলার সময় গর্বে আমার বুক ফুলে উঠতো। ভাবতাম কবে কলকাতা যাবো, ঋতবান নীলাঞ্জনা কে দেখতে পাবো।
চোখের সামনে একটা বালির ঘূর্ণন। সব অন্ধকার। একটা গভীর টানেলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি। স্পিড, স্পিড, স্পিড। দূরে, বহু দূরে, কোথাও যেন মোৎর্সাটের চল্লিশ নম্বর সিম্পনি জি-মাইনর স্কেলে বেজে চলেছে। সেই তাল, সেই ছন্দ, সেই লয়। আমি চলে যাচ্ছি ঘুমের দেশে। জমাট বাঁধা ঘুম। কোন স্বপ্ন নেই, শুধুই অন্ধকার, নিকষ কালো আঁধার।
(দ্বিতীয় কোন)
এখন বোধহয় মধ্যরাত্রি কিম্বা দিনও হতে পারে! আমি কি খুব আবছা দেখতে পাচ্ছি? নাকি আমার মনের ভুল? মাথা ঘোরানোর মতন শক্তি আমার নেই। সারা শরীরে বোধহয় অনেক নল, সুচ ফোটানো আছে! আমার কাছে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। মাথার মধ্যে একশ’ ঘোড়ার ছুটে চলার মতন দাপাদাপি। জীবনচক্রের চাকা হঠাৎ চলতে শুরু করলো। সাঁই সাঁই করে পিছনে চলেছে। অনেকগুলো দিন, মাস, বছর পিছিয়ে চলেছে। প্রায় তেত্রিশ বছর পেছনে ফিরে দেখা। এ যেন টাইম মেশিনে চড়ে নিজের অতীতকে দেখতে পাচ্ছি। সুযোগ থাকলে সেই সময়ের ছোট বড় ভুলগুলোকে আজ শুধরে নেওয়া যেতো। সে পথ বন্ধ। অতীতের ভুল থেকে বর্তমানে শেখা যায়, কিন্তু ফেলে আসা ভুলকে আর ঠিক করা যায় না।
সেটা ডিসেম্বর মাস, কলকাতায় সেদিন বেশ ঠান্ডা। সকালে হালকা রোদ থাকলেও পুরো হাতা সোয়েটার পরতে হচ্ছে। নীলাঞ্জনা কে নিয়ে সকালে হাসপাতালে গেছি। নীলাঞ্জনা সন্তান সম্ভবা। হাসপাতাল ভর্তি করে নিলো। হাসপাতালে নিচের উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলাম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীলাঞ্জনা। খবর এলো এখনই টাকা জমা করতে হবে।
আমার সঙ্গে অত টাকা নেই। বাড়ি গিয়ে ব্যাংকের চেক বই নিয়ে টাকা তুলতে হবে। দৌড়ে বাড়ি এসে চেক বই নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাসপাতালে ছুটলাম। টাকা জমা দিয়ে আবার হাসপাতালের উঠোনে। একজনকে ধরে নীলাঞ্জনার কাছে খবর পাঠালাম। নীলাঞ্জনা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো। আমি নিচে থেকে বললাম “কি হ’ল? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? হঠাৎ ভর্তি করে নিলো?”
নীলাঞ্জনা বললো “আমি ঠিক আছি। তুমি কোথাও চলে যেও না, এখানেই অপেক্ষা করবে।”
আমি বললাম “দূর বোকা, আমি কোথায় যাব? ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে বলেছে। আমি এখানেই আছি তোমার কোন চিন্তা নেই।”
নীলাঞ্জনা ভেতরে চলে গেল।
খুব ছোট হাসপাতাল। হাসপাতাল না বলে প্রসূতি সদন বলাই ভালো। হাসপাতালের গেটের সামনে একজনের থেকে এক ভাঁড় চা কিনে খেলাম, বেশ খিদে পেয়েছে। কিন্তু খেতে যাবো কি করে? নীলাঞ্জনা উপরে একা। যদি কোন দরকার পড়ে! আমায় খুঁজে না পেলে নীলাঞ্জনা অস্থির হয়ে পড়বে। উঠানে এসে দাঁড়ালাম- শীতের দুপুরের এক ফালি রোদ এসে আমার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে – বেশ লাগছে।
হাসপাতালের মাইকটা একটু ঘড়ঘড় করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে বলতে শুরু করলো “পেশেন্ট নীলাঞ্জনা বসুর বাড়ির লোককে অফিসে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে।”
দৌড়ে গেলাম অফিসে। উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা। কোন খারাপ কিছু হলো না তো! অফিসের একজন মহিলা কর্মচারীকে আমার পরিচয় দিতে, একমুখ হেসে বললেন “আপনার ছেলে হয়েছে। মা ও বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে। বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভিজিটিং আওয়ারে দেখতে যেতে পারবেন।”
খুব আনন্দ হচ্ছে। এক অদ্ভুত আনন্দ। সেই আনন্দের অনুরণন টের পাই সবসময়ে নিজের অন্তরে। সুরের সঙ্গে সুর মেলানোর পালা।
ধৈর্য ধরে বসে আছি কখন বিকেল সাড়ে চারটে বাজবে। নবাগত কে দেখতে পাবো। জীবনে এত আনন্দ আগে কখনো অনুভব করিনি। গুনগুন করে দুকলি গেয়ে উঠলাম
“সকল দুয়ার আপনি খুলিল
সকল প্রদীপ আপনি জ্বলিল
সব বীণা বাজিল নব নব সুরে সুরে
মম মন্দিরে কে আসিল হে! ”
বিশ্বকবি তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার এমন আনন্দের দিনের কথা ভেবে তুমি কবেই এ গান লিখে রেখে গেছো।
সবুর আর সয়না। কখন যে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে বাজবে! ওপরে যেতে পাবো, দেখতে পাবো নবাগত কে।
বাড়িতে আগেই খবর পাঠিয়েছি, একে একে সবাই এসে পড়বে। উচ্ছ্বাসে ভরে উঠবে হাসপাতালের উঠোন। এসব যখন ভাবছি, দারোয়ান এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলো। বললে “উপর থেকে শুধু আপনাকে দেখা করতে যাবার অনুমতি দিয়েছে”।
ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে এখনো বেশ দেরি। এক দৌড়ে দোতলার বিরাট হল ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। সারি সারি বিছানা পাতা। নীলাঞ্জনা বসে আছে। হাত তুলে আমায় ডাকলো। কাছে গেলাম। নীলাঞ্জনার বেডের পায়ের কাছে একটা ছোট্ট বেড। নীলাঞ্জনা ইশারায় ছোট্ট বেডটা দেখিয়ে আমায় বললো “ও ওখানে – দেখতো কাঁদছে কিনা?”
আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম, একটা এত্তোটুকু জীবন। ঠিক যেন পুতুল, কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। আমার সন্তান – আত্মজ।
নাকটা একটু বোঁচা, কিন্তু কি আরামে ঘুমোচ্ছে।
নীলাঞ্জনা আমাকে বললো “তুমি মেয়ে চেয়েছিলে, আমাদের ছেলে হয়েছে। তুমি খুশি হওনি?”
আমি বললাম “ও আমাদের সন্তান, এর চাইতে বড় আর কি হতে পারে? আমি দারুন খুশি হয়েছি। আজ থেকে তুমি মা আর আমি বাবা হলাম।”
ভিজিটিং আওয়ারে কত লোক। সবাই এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল। মা, দাদা, বৌদি, তোমার বাড়ির সবাই। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। মনে মনে ভাবছি কবে তোমাকে আর ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাব। একটু বড় হলে ছেলেকে গল্প বলবো – ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির গল্প, ক্যাসাবিয়াঙ্কার গল্প। তখন আমাদের ছেলের দু’দিনও বয়স হয়নি। নীলাঞ্জনা যতদিন হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে, আমি সকালে চলে আসি সারাদিন হাসপাতালে থেকে, এক্কেবারে রাত্রে বাড়ি যাই।
কত বই ঘেঁটে, নীলাঞ্জনা আমি দুজনে কত আগে থেকে, ঠিক তর্ক নয়, নাম রাখা নিয়ে খুনসুটি করতাম। ঠিক করেছিলাম মেয়ে হলে নাম রাখব রাই ছেলে হলে ঋদ্ধি। যখন ছেলে হল নীলাঞ্জনার দিদি নাম রাখল ঋতবান। ভারি সুন্দর নাম।
ঋতবান হয়তো নিচের লাউঞ্জে অপেক্ষা করে আছে। কিসের অপেক্ষা? খবরের অপেক্ষা। ভালো অথবা মন্দ। চোখের সামনে একটা বালির ঘূর্ণন – একটা গভীর টানেল – দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা – বাঁকে বাঁকে ওতপেতে বসে আছে হিংস্র হায়নার দল। একটু অসাবধান হলেই দেয়ালে ঘষে যাবে শরীর। স্পিড, স্পিড, স্পিড।
আমি বেশ ভালো আছি, আমার মন যেন পাখির পালক। ফুরফুরে মেজাজ। কে যেন আমার কানের কাছে এসে চুপি চুপি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনগুলি পড়ে যাচ্ছে –
“আলো-অন্ধকার যাই মাথার ভিতর
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাতে, রাখে হাত। ”
ঘুম নেমে আসছে দুচোখের পাতায়। ঘুমের সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। নিকষ কালো আঁধার। দূরে, বহু দূরে একটা আলোর বিন্দু। উল্কার গতিতে ছুটে আসছে। আমি শত চেষ্টা করেও ওটাকে থামাতে পারছি না………..।
(তৃতীয় কোণ)
দিন, মাস তারিখ, সময় – আমার কাছে এখন সব অজানা, অচেনা। আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সাবলীল নয়। যন্ত্রণা, ব্যথা, কষ্ট পেতে পেতে এক সময় সব সহ্যের মধ্যে চলে আসে, নতুন করে কিছু উপলব্ধি করা যায় না। আমার অবস্থা কতটা সেই রকম; আমি এখন এসবের ঊর্ধ্বে, এক মহাশূন্যে অবস্থান করে আছি। মাথার মধ্যে আবার সেই দাপাদাপি, অশ্বমেধের ঘোড়া। একটা নয়, অনেক ছুটে চলেছে গেরুয়া রঙের ধুলো উড়িয়ে। গোল গোল, ছোট ছোট চক্রের মতন কি সব নেচে বেড়াচ্ছে। চলতে শুরু করল জীবনের ফেলে আসা চলচ্চিত্র। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা বছর পিছিয়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
কাল সরস্বতী পুজো। বাড়ির সামনে চৌকো ফাঁকা জমিটায় প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। ছোটরা সবাই মেতে উঠেছে। আমি যখন ছোট ছিলাম, স্কুল কলেজের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, তখন ওই পুজো আমরা বন্ধুরা মিলে করেছি। প্যান্ডেলের পেছনে একটা ঘর বানাতাম। সেখানে রাত জাগার নাম করে সিগারেট ফোঁকা মকশো হতো। তারপর বয়স বাড়লো, রিলে রেসের ব্যাটনের মতন সরস্বতী পুজোর ভার পড়লো আমাদের পরের ব্যাচের উপর। তারপরে আরও ছোটদের, সেই ট্রাডিশন আজও চলছে।
ছোটবেলার সেই বন্ধুরা আজ আর সবাই একসঙ্গে নেই। কর্মসূত্রের তাগিদে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ছোট বয়সে পাড়ার সাত্যকি, সতু, আজ বোস বাবু। হারিয়ে যাওয়া জীবনকে ফেরত পাওয়া যায় না। চার্বাক দর্শনের বিখ্যাত বাণী ‘যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত, ভষ্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।’ মৃত্যু ভয়ে ভীত না হয়ে যতদিন বাঁচবে, আনন্দে বাঁচো। দরকারে ঋণ করে হলেও ঘি খাও। এই দেহ একবার পুড়ে ছাই হয়ে গেলে কোনভাবেই ফেরৎ আসবে না।
যে কথা বলছিলাম, সরস্বতী পূজার আগের দিন আমি অফিসে। পাড়ার একটি ছেলে হঠাৎ আমায় অফিসে ফোন করলো “হ্যালো সতুদা, আমি ভুতু বলছি”।
আমি বললাম “হ্যাঁ বল, কি হয়েছে?”
ভুতু বললো “মেসোমশাই এর শরীর খুব খারাপ, আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে এসো।”
অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি এলাম। পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড়। বাবা মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলাম, বাবা বিছানায় শোয়া, গায়ে একটা কালো আলোয়ান চাপা দেওয়া। মা বাবার মাথার কাছে সোফা-কাম-বেডে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছে।
বাবা নেই এই কথাটা বুঝতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগলো। কত মিনিট বা কত ঘন্টা বলতে পারবো না। উপলব্ধি করলাম মাথার উপর থেকে কি যেন একটা সরে গেল। অনেকটা যেন, কাল অবধি আমি একটা শক্তপোক্ত ছাদওয়ালা বাড়িতে ছিলাম, আজ থেকে সেই ছাদ নেই। কেউ একজন বাড়ির দেয়ালগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। একটা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মাঝে আমি একা, এক্কেবারে একা।
আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, পরিচিত – অনেকের মৃত্যু দেখেছি। শ্মশান যাত্রার সংখ্যা আমার ঝুলিতে কিছু কম নেই। তবুও বাবার চলে যাওয়া জীবনে একটা বড় আঁচড় ফেলে দিলো। সেটা ছিল তেসরা ফেব্রুয়ারি। আমার এবং আমার বাবার জন্মদিন কাকতালীয়ভাবে একই দিনে পয়লা আশ্বিন।
একে একে সব আত্মীয়রা আসতে লাগলো। আমার দাদা কর্মসূত্রে খড়্গপুরে। তাকে খবর পাঠানো হলো। আমরা সবাই আশা করছিলাম যে খবর পেলেই দাদা চলে আসবে। সারারাত ধরে বাড়ির সামনের রাস্তায় পালা করে তিন চার জন দাঁড়িয়ে আছি। একটা করে ট্যাক্সি যাচ্ছে, ভাবছি এতে হয়তো আসছে। যাকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো সে পরদিন ভোরে রওনা হয়ে দাদাকে বেলার দিকে খবর দেয়। আত্মীয়রা আমায় বারবার বলতে লাগলো “ব্রাহ্মণ মড়া বাসি করতে নেই, তুই তো আছিস, চল আমরা সৎকার করে আসি।”
আমি প্রতিবার বলেছি, “দাদা আগে আসুক, তারপর যা হবার হবে”।
সে দাদাও আজ বেশ কিছু বছর হলো নেই।
দাদা এলো। মা, দাদাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিত। দাদা মাকে সান্তনা দিয়ে বলতে লাগলো “তুমি এতো ভেঙে পড়ছো কেন মা? আমি তো আছি।”
অত্যন্ত স্বার্থপরের মতন বলছি আমি কি রকম একটা স্বস্তি পেলাম। দাদা আছে, বাবা চলে গেলেও আমাদের মাথার উপর থেকে ছাদ একদম সরে যায়নি। শক্ত ঢালাই ছাদের পরিবর্তে একটু কমজোরি একটা ছাদ পেয়েছি। ফাঁকা মাঠের চাইতে অনেকগুণ ভালো।
শ্মশানের কাজ শেষ করে সন্ধ্যেবেলা আমরা দুই ভাই ঘরে বসে আছি। আমি ভাবছি আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে? এতদিন কোন সমস্যা হলে বাবাকে বলতাম। এখন কাকে বলবো? শুভবুদ্ধি আমায় কে দেবে? আমার চিন্তা মগ্নতা দেখে আমার দাদা বোধহয় কিছু বুঝতে পারলো। আমাকে বললো “তুই এত কি ভাবছিস বলতো?” আমি বললাম “না:, সেরকম কিছু নাহ। আবার কিছু যে একদম ভাবছি না সেটাও বলা ভুল।”
আমার দাদা বললো “এত ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা-মা কারো চিরদিন থাকে না। তাছাড়া একটা কথা মনে রাখবি, আমি কলকাতায় থাকি না বটে, তবে কোন কিছুর দরকারে আমাকে জানাতে দু’বার ভাববি না। আমি সব সময় পাশে আছি।”
খুব আনন্দ হয়েছিলো। আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য আমার দাদা আছে। এই যে মনে ভরসা দেওয়া, এটাই তো মানসিক সাপোর্ট। এটার জন্যই তো লোকে বন্ধু খোঁজে, পরিবারের সান্নিধ্য পেতে চায়।
সান্নিধ্য, সান্নিধ্য। আবার সেই বালির ঘূর্ণন। বৃহৎ ঘূর্ণন পাক্ খেতে খেতে একটা ছোট চোঙের মতন হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অতল গহ্বর। কালো গোল টানেলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা। একটু বেসামাল হলেই দেয়ালে ঘষে যাবার সম্ভাবনা। অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার; কোন শেষ নেই। স্পিড, স্পিড, স্পিড।
“একো বৈ নারায়ণ আসীন
ন ব্রহ্ম, ন ঈশান, ন অপ, ন অগ্নি।
সমৌ নেমে দ্যাবাপৃথিবী
ন নক্ষত্রাণি, ন সূর্যঃ।।”
– নারায়ণ উপনিষদ
{সৃষ্টির আদি তে ব্রহ্মা ছিলেন না, শিব ছিলেন না, অগ্নি ছিলেন না, চন্দ্র, সূর্য এমনকি আকাশে কোন নক্ষত্র ছিল না – তখন ছিলেন পরম পুরুষ নারায়ণ}
(চতুর্থ কোণ)
সময়ের হিসেব আমার কাছে আর নেই। এখন মনে হচ্ছে একটু যেন ভালো আছি, ভালোর অনুভূতি পাচ্ছি। কিছু দেখতে পাই না, তবে চোখের পাতা খুলতে পারি। শরীরের কোন অঙ্গকে উপলব্ধি করতে পারি না। আমার হাত, পা, গলা, নাক – কিছু আছে, টের পাই না। একটা মাংসপিণ্ডের মতন বিছানায় শুয়ে আছি। মাঝে মাঝে ঘোড়া ছুটে যাবার শব্দ। এখন অনেক বেশি, অসহ্য, যন্ত্রণাদায়ক। একশ’ ঘোড়ায় টানা মহাকালের রথ। শুধুই দাপাদাপি, রথের চাকার ঘষটানো আওয়াজ। সারথি, সওয়ারি, রথ বা ঘোড়া- কিছুই দৃশ্যমান নয়। শুধু দাপাদাপি, শুধুই আওয়াজ। মাঝে মাঝে শুনি হ্রেষ্বা ধ্বনি।
জীবনের চাকা, কালের চাকা ঘুরতে শুরু হল। সব পিছনে সরে যাচ্ছে। মানুষ, বাড়ি, রাস্তা, দোতলাবাস। কোন বাড়ি, কোন রাস্তা, মানুষটা কে – কিছুই চেনা নয়। হঠাৎ এসে থেমে গেল।
আমার মা। যে মাকে আমি মৃত্যু শয্যায় দেখেছিলাম, বয়সের ভারে রুগ্ন, মাথায় কাঁচা পাকা চুলের কয়েকটা অবশিষ্ট নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, সে মা নয়। আমার ছোট বয়সের মা, তরুণী। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। আমি মায়ের কোলের কাছে, মায়ের পাশে শুয়ে, সাদা কাপড়ে মোড়া – সদ্যজাত। আমার মা, পরম যত্নে, পরম আদরে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমার মায়ের সাত্যকি।
একটু আগে নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে, জঠরের ওমের মধ্যে থেকে রক্তাক্ত হয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছি। আমার শরীরে এখন আর মায়ের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারি না। এত দিনের অভ্যেস আজ এক কাঁচির খোঁচায় আলাদা হয়ে গেল। আমার নতুন অস্তিত্ব, আমি স্বতন্ত্র। আমার খিদে, কখনো আমায় বিচলিত করেনি। আমার ঘুম, কখনো ভাঙেনি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আজ অবধি যা করতে হয়নি – আজ এই কয়েক মুহূর্ত আগে থেকে সেটা করতে হচ্ছে। পৃথিবীর উজ্জ্বল আলো, আমার বিব্রত করছে। আমি বিরক্ত। দু হাতের মুঠি শক্ত করে প্রতিবাদ করে চলেছি। আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার বিরক্তের ভাষা একটাই – কান্না।
আমার কান্নায় তোমরা আনন্দে পেয়েছো। তোমরা আমার এতোটুকু শরীরে কান্না এনে প্রমাণ করতে চেয়েছো যে আমার শরীরে প্রাণ আছে। আমি এই মুহূর্তে তোমাদের গলা ফাটিয়ে বলে যেতে চাই “যেদিন আমার শরীর থেকে প্রাণ বায়ুটা উড়ে যাবে, সেদিন তোমরা সবাই কাঁদবে। আমি একা হাসবো।”
আমার ভূমিষ্ঠ হবার খবর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। শঙ্খ ধ্বনি, উলুধ্বনিতে আমার আগমনকে স্বাগত জানাতে সবাই ব্যস্ত। মিষ্টি বিতরণের পালা শুরু হবে। সংসারে নতুন অতিথি। আমার মা আমাকে পরম স্নেহে, পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। আমি তাঁর আত্মজ।
এতদিন শুনে এসেছি ‘মানুষ খুব ছোট বয়সের কথা মনে করতে পারেনা।’ আমি কি করে পারছি? তাহলে কি আমার হাসির সময়, তোমাদের কান্নার সময়, একইসঙ্গে কাছে চলে এসেছে?
সারাদিন কত লোকের আনাগোনা। যারা খুব কাছে এসে দেখছে, আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি বটে তবে বুঝতে পারছি না। কত শব্দ, কত আওয়াজ – যেন স্ফটিকের ভেতর থেকে ভেসে আসা ব্রহ্মশব্দ। সে শব্দের অর্থ আমি জানি না, বুঝতে পারি না। এত কোলাহল আমার ভালো লাগছে না। আমি বিরক্ত, কিন্তু তোমাদের সে কথা বোঝাতে পারছি না।
আমি বিরক্ত। আমার ভালো লাগছে না। আমার সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া অবস্থা – এখনের অবস্থা, সব এক হয়ে গেছে। একটা বালির ঘূর্ণন বৃহৎ মরুভূমির ভিতর। দূরে স্টিমারের ভোঁ। অতল গহ্বর, আমি হাওয়ায় ভেসে চলেছি। স্পিড, স্পিড, স্পিড। দেয়ালের সঙ্গে ঘষে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেক চওড়া টানেল। দূরে একটা আলোক বিন্দু। আমি এগিয়ে চলেছি।
টানেলের শেষে সব সাদা, মহাশূন্য। একশো ঘোড়ার সুসজ্জিত রথ, অচেনা সারথি। আমি সেই রথে চড়ে সসীম থেকে অসীমে ছুটে চলেছি। ভেসে আসছে পারিজাতের গন্ধ। আমার কোন কষ্ট নেই, বেদনা নেই, ক্লেদ নেই, ক্ষোভ নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই। আছে আনন্দ, অপরিসীম। আজ বোধহয় তেসরা ফেব্রুয়ারি! আমার জীবন তার হ্লাদিনী শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছিল এই শরীরকে। সেই শরীরের প্রয়োজন আর নেই, ত্যাগের সময় উপস্থিত।
পথে দেখা শ্বেত শুভ্র গোঁফদাড়ি, মাথার উপর জটার চূড়া, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গেরুয়া বসন, বিশাল অশ্বথ গাছের ছায়ায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন ঋষি যাঞ্জবল্ক্য। সামনে মুণ্ডিত মস্তকে হাত জোড় করে বসে ছাত্রদল শুনছেন ঋষির জলদ গম্ভীর কন্ঠে বৃহদারণ্যক উপনিষদ —
“আসতো মা সদগময়ঃ
তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ
মৃত্যো মা অমৃত্গময়ঃ
ওঁ শান্তি; শান্তি; শান্তি।।”
{অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে আমাদের অমৃতের দিকে নিয়ে যাও, চির শান্তি বিরাজ করুক}
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.