খেয়ালের খেরো খাতা – ভালো লাগার মতো ভালো একটি বই
Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays…
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের লেখা ‘খেয়ালের খেরো খাতা‘ সাম্প্রতিককালে মায়া বুক্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির একটি রিভিউ রইল পাঠকদের জন্য সন্দীপ ঘোষের কলমে।
‘খেয়ালের খেরো খাতা’-র লেখক সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটিই তারকা চিহ্নিত হলেও, যা লিখেছেন তা শুধুমাত্র কোনও এক বিশেষ শ্রেণীর পাঠক কুলের জন্য নয়, বরং যারা সহজ কথা সহজ ভাবে বুঝে আনন্দ পান, তাঁদের জন্যই।
তিনকুড়ি থেকে মাত্র দুটি কম, ছোট লেখা পড়ে বোঝা গেল যে কর্পোরেট দুনিয়ায় পা রেখেও বই পড়া গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চবুতরায় অনায়াস পদক্ষেপ সম্ভব।
তার ভাষায় লেখাগুলি কল্পনা ও স্বপ্নের মিশেল, স্মৃতিবিলাস বা নিছক অবচেতনের আঁকি বুঁকি যাই হোক না কেন সেগুলির সঙ্গে পাঠকের একাত্মীকরণে কোন অন্তরায় সৃষ্টি হয় না। তার এই নিজস্ব খেয়ালিপনার লতাগুল্মের পাকে পাকে জড়িয়ে পাঠককে পরিতৃপ্তির উদ্গার তোলাতে পেরেছেন এটি অনস্বীকার্য ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে এসেছিল – The Great Family Nourisher’। পূর্বে বঙ্গদেশ, উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব আর দক্ষিণে তামিলনাডু – এই তিনটি অঞ্চল জুড়ে সব থেকে বেশি চাহিদা ছিল এর। কার? যাকে ছাড়া সুচিত্রার সংসার ছিল অচল। আশির দশকে কাঁচের বোতলের বদলে এল প্লাস্টিক বোতল।
“ট্রামে বাসে বাদুর ঝোলা, আরে বাবা শরীরটাকে তো রাখতে হবে,” ” আমি কেন খাই ….দারুন লাগে”, “আমি তো এমনি এমনি খাই” ।
বইয়ের প্রথম লেখাটির শিরোনাম “হরলিক্স আরো বেশি পুষ্টি দেয়” । অতি মনোরম। ক্রিকেটের ব্যাট হাঁকরানোর মতো, কলম হাঁকরেও যদি পাওয়া যেত ছক্কা, তাহলে আমার মতে নস্টালজিক এই লেখাটি “ছক্কা” ই হাঁকিয়েছে।
শেষ লেখাটির শিরোনাম, “স্বাধীনতা তুমি”। এতে কৌতুক থাকলেও ভাবার মতন বিষয় আছে। “তেরঙ্গা উড়ুক। সঙ্গে থাকুক রামধনুর অন্য রঙেরাও। বিজ্ঞান বলে, সাদা রং আদপে সব রঙের সমষ্টি মাত্র। আর সেই সাদা হল শান্তির
দ্যোতক, তা ভুলি কি করে?” – আবারো ছক্কা!
আর এই দুইটির মাঝে আরো ৫৬ টি মারকাটারি ছয় ও চার আছে, এক, দুইয়ের কোনো ব্যাপারই নেই।
“শীত বুড়ো” আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু তাকে নিয়ে দুপাতা লিখে যে পাঠকচিত্ত জয় করা যায়, তার নজির এই লেখাটি।
”মামা কাহিনী”-র অজু মামা গোপাল মামা রাঙা মামা কেশব মামা এরা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় হাজির হয়েছেন ভাগ্নে সপ্তর্ষির কলমে।
“ভোকাট্টা”- য় গাওয়া গেল একতে, দোতে, আধতে। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি। চৌখুপি, বাসমার, চাপরাশ ইত্যাদি। পাওয়া গেল ‘ঘাই মারো মারো ঘাই ‘। মনে পড়ে যায় দামালপনার সেইসব দিনগুলোর কথা। আজকের ভাষায় বলা যায় ‘জিও কাকা’ ।
”কিষাণ” পড়তে পড়তে, মিল খুঁজে পেলাম, আমার বাড়ির সামনে, পার্কের বাঁদিকের কোনায় অস্থায়ী বাড়ি ও দোকানের মালিক ইস্তিরিওলার সঙ্গে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে নাকি তারও বেশি সময় ধরে আমি তাকে রাকেশের বাবা বলি জানি। আমিও আছি, তারাও আছে, তবু আজও তার নামটা জানা হয়নি। লেখক হওয়া কি মুখের কথা।
আমার অসম্ভব ভালোলাগা একটি লেখা “মেকুর চরিত” । অনেকেই হয়তো জানেন না মেকুর বলা হয় বিড়ালকে। সিলেটি হওয়ার সুবাদে এই শব্দটির সঙ্গে আমার আবাল্যের পরিচিতি। উপরন্তু আমার বাড়িতে গোটা চার পাঁচ মার্জার সব সময় থাকে। লেখক মেকুর চরিত জানাতে চৌদ্দশ শতকের ইংরেজ মনীষী থেকে বঙ্কিমচন্দ্র ও মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে পর্যন্ত কেমন অবলীলায় জুড়ে দিলেন। তাই বাহবা বলতে বাধা কোথায়?
চতুর্দশীর কালে আকাশের নিচে আলোর রোশনাই গায়ে মেখে পড়ে থাকে যে আরেক কলকাতা তা পাওয়া গেল, “বলি আরেক কলকেতার গপ্পো”- তে। সাবাশ!
“শোনো অভ্যেস বলে, কিছু হয় না পৃথিবীতে, পাল্টে ফেলাই বেঁচে থাকা”, এটি আমি মানি বা না মানি, তাতে কিন্তু ‘মহালয়া’ -র স্মৃতি মেদুরতা কিছু কম হয়ে যায় না। ভালো।
“স্বখাত সলিলে “- র drunken monkey hypothesis থেকে ছোটা ব্রিস্টল পর্যন্ত টলোমলো হয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ জ্ঞানার্জন হল উপরি লাভ। লা জবাব।
শিবরাম চক্রবর্তী কাছ থেকে ধার নেওয়া শিরোনাম ‘Call কারখানা’ তেও লেখক তার সজীব সরসতায় টেলিফোন, টেলিফোন ডিরেক্টরি, ট্রাঙ্ক কল, আট সংখ্যার দূরভাষ নম্বর নিয়ে যেভাবে কলম হাঁকিয়েছেন তা প্রশংসনীয়।
লেখকের সঙ্গে ‘মানস‘ অভয়ারণ্য ঘোড়ার মজাই আলাদা। ভুঁইয়াপাড়া হয়ে রুপাহী ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাতির পাল দেখে ডাউসেন ওয়াচ টাওয়ার হয়ে, পাহাড়ি নদী দইপারি ও বন্যায় ভেঙে পড়া ব্রিজ দেখে রিসোর্টে ফিরে বার্কিং ডিয়ারের ডাকে ঘুমিয়ে পরদিন সকালে বাঁশবাড়ি রেঞ্জের ভিতর দিয়ে ভুটানের সীমানা পেরিয়ে পাণবং গ্রাম থেকে মানস নদীকে কাছ থেকে দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কিছু। হ্যাপা যা পোহানোর সে তো লেখক পুহিয়েছেন, পাঠক তো পাঠভ্রমণ করে ফেললেন অতীব আনন্দে। ধন্যবাদ।
এমনভাবে লিখতে থাকলে খেয়ালের খেরো খাতা থেকে পর্যালোচনার কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না তাই থামা উচিৎ। আসলে কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি। যেমন, “প্রাগৈতিহাসিক”, “কালিকা”, “হনুভগবান” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদির উপস্থাপনায় লেখকের মনন চিন্তন ও সর্বোপরি লিখনের বাহাদুরিতে পাঠক মুগ্ধ হবেনই।
মায়া বুক্স প্রকাশিত সুন্দর বাঁধাই ও ঝকঝকে ছাপা বইটির নামের সঙ্গে পার্থ দাশগুপ্তর প্রচ্ছদের সাথ-সঙ্গত প্রশংসার্হ।
৩০০ টাকা মূল্যের বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬৮ ও বয়স মাস চারেক মাত্র তবে আশা রাখি পাঠকের মজলিসে এটির অনুরণন চলবে বহু সময়ব্যাপী।
বইটির প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের জন্য রইল আমার হার্দিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
বইটি পাবেন নিচে দেওয়া অনলাইন বিপণিতে :
www.thebengalstore.com/books/maya-books/kheyaler-khero-khata
What's Your Reaction?
Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays clear of politics, sports or regular curricular studies, but loves learning varied issues. His personal romance is theatre. Now 61, he has worked in various embassies and private organisations, but ploughs himself back into acting whenever he can. His latest book is titled “Theatre in the Districts and Suburbs”