কিশোরবেলার আবহাওয়া “কত শিলিং এ এক পাউন্ড”
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
আবহাওয়া এবং জলবায়ু – একটা একদিনের অন্য টা গড়পড়তা। ছোটবেলার অসম্ভব দুরন্ত ছেলে যদি আজ কলম ধরে ফেলে আসা দিনের কথা লিখতে বসে, বেশ মজা লাগে। তাই না? আসুন দেখি সেই দিনগুলো কথার মালায় কেমন সাজিয়েছেন রাজকুমার মুখার্জি দ্বিতীয় পর্বে ।
ছেলেবেলার থুড়ি, কিশোরবেলার দ্বিতীয় পর্ব লিখতে বসে অনেক স্মৃতি ভেসে উঠছে, আবার জলের উপরে বুদবুদের মতন মিলিয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া ভয়ংকর । কোনটা কার আগে, কোনটা কার পর, ঠাওর করতে পারছি না।
থাকুক ওসব জ্যামিতিক প্রমাণ একদিকে; আমি বলি আমার কথা। আগের বার আবহাওয়া বলেছিলাম, আজও বলবো সেই রকম আবহাওয়ার গল্প। সিগারেট ফোঁকা বেশ রপ্ত করে ফেলেছি। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিগারেট চারজনে ভাগ করে খাই। হরিহর আত্মা। আমার দু একজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আজও ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ আছে, তা অস্বীকার করি কি করে?
আমার আবহাওয়ার সঙ্গে আমার বাড়ির আবহাওয়া একদম মিল খায় না। তেল আর জল। আমার পিতৃদেব ছিলেন অতিমাত্রায় সৎ, ভদ্র, শিক্ষিত, গুণী – ভালোর যত রকম বিশেষণ বসানো যায়, সব ওনার মধ্যে ছিল। আমি আমার সারা জীবনে ওই রকম আর কাউকে দেখিনি। এই ভদ্রতার সুযোগের আমি সদ্ব্যবহার পুরো মাত্রায় করেছিলাম। একটা উদাহরণ দিই। আমার পিতৃদেব আমাকে বললেন তুমি কমার্স পড়ছো, Batliboi বা Shukla & Grewal এর একাউন্টান্সির ওপর যে বইগুলো আছে সেখান থেকে অংক প্র্যাকটিস করো। আমি এক কথায় বললাম নিশ্চয়ই। কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে বই জোগাড় করলাম। এবার বই দুটির যে উপকারিতা ছিল, যেটা আমার আবহাওয়া সঙ্গে মিশে যায়, সেটার সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি।
এক, বই দুটির এক একটি দু কেজির চেয়ে কিঞ্চিত বেশি ওজন। যদি দুই হাতে দুটো বই নিয়ে যদি ওঠ-বোস করা যায়, হাতের মাসেলস্ বাড়বে।
দুই, বাড়ি থেকে যদি কোনদিন বলে যাও ‘আজ থেকে আর ঘরে জায়গা হবে না রাস্তায় গিয়ে থাকো’, তাহলে মাথার বালিশের পরিবর্তে যে কোন একটা বই কাজে লাগানো যেতেই পারে।
তিন, এই বইয়ে যেকোনো একটা কারো মাথায় ছুঁড়ে মারলে সে নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে যাবে। শক্ত মালাটের বাঁধাই সহজে ছিড়ে যাবার সম্ভাবনাও নেই।
অর্থাৎ আমার কাছে অংক ছাড়া বইয়ের অন্য উপকারিতা প্রচুর । ওই যে বলে না ফাইন্ড দ্য প্রপার অপরচুনিটি আমি সেইটাই কাজে লাগিয়েছিলাম।
পিতৃদেবের আবহাওয়া ছিল বা ধারনা ছিল — মন দিয়ে পড়ো। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আমার আবার অন্য ধারনা — অত পড়ে কি হবে বাপু? বই মুখে করে বসে থাকলে দুনিয়ার বাকি কাজগুলোর কি হবে? তার দায়িত্ব কে নেবে? অতএব, পড়ার বই তাকে তোলা থাক।
আমি ওই মোটা মোটা বইগুলোর বেশ কিছু অংকে পেন্সিলের টিক দিয়ে রেখে রাখলাম। যদি কেউ কখনো বই খুলে দেখে তাহলে সে বুঝবে আমি এখান থেকে অংক করি। আমি একটা অতি পাতলা একাউন্টান্সির বই কিনে তার অংক করতাম। বেশিরভাগ অংকই মিলতো না এবং সেটাই স্বাভাবিক।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা মাথার কাছে চলে এসেছে। পিতৃদেব একদিন Batliboi এর বই খুলে দেখছেন। আর আমি ভাবছি এবার কি ফাঁপরে পড়বো! বাবা মুচকি মুচকি হাসছেন, আমার মনে বল এলো। ভাবলাম আমার অংকে দাগ দেয়া দেখে উনি খুব খুশি হয়েছেন। আমিও good boy এর মত অভিনয় করতে লাগলাম।
আমার ধারনার বাইরে আবহাওয়া পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। বাবা হঠাৎ আমায় বললেন “যে অংক গুলো দাগ দেওয়া, সেগুলো তুমি করেছো”? আমি বুক ফুলিয়ে মিথ্যে বললাম – হ্যাঁ। উনি বললেন “বইটা তো বেশ পুরনো”। আমি বললাম “হ্যাঁ কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনেছি”। বাবা বললেন “কত শিলিং এ এক পাউন্ড?” আমি বললাম “আমি কি করে বলবো?” পিতৃদেব রেগে আগুন। আমায় বললেন “অংক গুলোর ফিগার সব পাউন্ড শিলিং এ দেওয়া।” এইরে এবার কি হবে? আমি তো ঠিক করে অংক গুলোই কোনদিন পড়ে দেখিনি। কি জ্বালা, সস্তায় কবেকার বই কিনে এনে কি ফ্যাসাদে পড়েছি! আজ আমার কপালে ধোলাই আছে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমার পিতৃদেব কখনো মারতেন না। বইটা টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে বললেন ‘রাবিশ’।
এত টেনশন ওনার সহ্য হলো না। তাই হয়তো ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। বহুদিন হাসপাতালে ছিলেন, তবুও আমার আবহাওয়ার কোন পরিবর্তন হলো না। এক একবার এক এক রকমের। বাবা বলতেন “যার লেখাপড়ার প্রতি এত বিতৃষ্ণা, তার কিস্যু হবে না।”
জলবায়ু আবহাওয়া সব উলটপালট করে শেষমেষ কিছু একটা করে দুবেলা গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু আমার সবচাইতে বড় আফসোস — আমার পিতৃদেব, যিনি আমার জীবনে কিস্যু হবে না বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, তিনি দেখে যেতে পারলেন না যে গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিব্য জীবনটা কাটিয়ে চলেছি। কাল কি হবে অবশ্য জানিনা। কালের কথা কালের আবহাওয়া বলবে।
এর পরের দিন গল্প বলব আর এক অভিনব বজ্জাতির। হয়তো বা আপনার সঙ্গে আমার গল্পের কিছুটা মিলও থাকবে।
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.