Now Reading
কালিকাপ্রসাদ – কিছু কথা  

কালিকাপ্রসাদ – কিছু কথা  

Avatar photo
কালিকাপ্রসাদ

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য – কারো কাছে ‘কালিকা’ , কারো কাছে বা শুধুই ‘প্রসাদ’.. বাংলা , বাংলাদেশ আর উত্তর পুব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লোকগানকে গলায় নিয়ে জয় করেছে মানুষের হৃদয় । নাগরিক মননের সঙ্গে লোকায়ত সংস্কৃতির সেতু বন্ধনে পড়শির গান , পড়শির কথা পেয়েছে সর্বজনীনতা। তার দেখানো পথে এগিয়ে চলেছে ‘দোহার’ এক অভিষ্ঠ স্বপ্নের লক্ষ্যে । আজও মঞ্চে পাদ প্রদীপের আলোয় কালিকা উদ্ভাসিত ।আজ কালিকাপ্রসাদের জন্মদিন ।

কিছু খবর বিশ্বাস করতে সময় লাগে ; মন চায় না – মনে হয় কতই তো গুজব রটে – এও হয়তো তেমন কিছু । কিন্তু না । এই খবরটা যে ভীষণ সত্যি । ভীষণ রকম । কালিকা নেই । মন খারাপ করা সে দিনটা ছিল ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ ।

আসলে যে স্বপ্ন দেখে কালিকা পথ চলা শুরু করেছিল তার মধ্যে ছিল একটা প্রত্যয় এবং বিশ্বাস । এবং সেই কারণেই রাজীব, সুদীপ্ত , অমিত , মৃগনাভি, ঋত্বিক, সত্যজিৎ , রাহুল এবং নিরঞ্জনদার হাত ধরে   সময়ের সঙ্গে “দোহার” আবার ফিরেছে মঞ্চে , এক আগুনের পাখি হয়ে ! আজ সে এসে দাঁড়িয়েছে পঁচিশের দোরগোড়ায় ।

কালিকাপ্রসাদ জন্মসূত্রে পেয়েছিল এক বর্ণময় সাংগীতিক পরিবেশ । বরাক নদী উপত্যকার শিলচর শহরে ভট্টাচার্য পরিবারে ঘটেছিল নক্ষত্র সমাবেশ । পেশা হিসেবে গায়ন -বাদন ইত্যাদিকে সে ভাবে গ্রহণ না করলেও ,সঙ্গীতের না না ক্ষেত্রে কৃতি মানুষ ছিলেন সেই পরিবারে ।  কাকা শ্যামাপদ ভট্টাচার্য ছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খান এবং গায়ক তারাপদ চক্রবর্তীর ছাত্র । পরে ঢাকা রেডিয়তে একজন অনুমোদিত গীতিকার হিসেবে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘকাল । ১৯৬১ সালে ১৯শে মে যে ভাষা আন্দোলন হয় বরাক উপত্যকায় সে সময়ের “ভাষা শহীদের গান” তাঁর এক বলিষ্ঠ রচনা ।   অপর কাকা মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য ছিলেন বরাক উপত্যকায়  ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের কার্যাবলীর সঙ্গে যুক্ত । ইনি পরবর্তী কালে লখনৌ স্থিত ভাতখন্ডে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকনৃত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক । কালিকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা গঠনের ক্ষেত্রে ইনার ভুমিকা অপরিসীম।

মায়ের চেয়েও বেশি হয়ত বা যে মানুষটির সঙ্গে ছিল কালিকার হৃদয়ের টান , তিনি ছিলেন তার পিসী  আনন্দময়ী ভট্টাচার্য । অসামান্য দক্ষতায় গাইতে পারতেন । পরিবারের যে সঙ্গীত শিক্ষার স্কুল “শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়”,আমৃত্যু তিনি ছিলেন তার অধ্যক্ষা ।

কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য এর প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বেশী পড়েছিল কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর উপরে ।  যিনি বাস্তবিক ছিলেন লোকগানের ভাণ্ডারী এবং এক অর্থে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর মেন্টর । পেশায় একজন সফল আলোকচিত্রী হিসেবে দীর্ঘকাল ফটো ডকুমেন্টেশনের কাজ করেছিলেন ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে চীন ভারত সীমান্তে দু’দেশের সামরিক সংঘর্ষের কালে । পাশাপাশি না না ধরণের  বাদ্য যন্ত্রে ছিল তাঁর সহজাত পটুতা । পরবর্তী কালে তুরফান আলি নামে এক রিক্সা চালকের সঙ্গে হঠাৎ একদিন তাঁর পরিচয় ঘটে । আর এটাই ছিল তাঁর জীবনের একটি মোড় । দোতারা বাদক তুরফানের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে  পরিবর্তন ঘটে তাঁর জীবন ধারায় , বেশ ভূষায় এবং তিনি লোকগানের খোঁজে পথকে সাথী করেন । বাউল, ফকিরের  ডেরায় ডেরায়  ঘুরে  গান সংগ্রহ করেন তিনি । কালক্রমে লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার বেড়ে ওঠে এপার – ওপার দুই বাংলা এবং আসাম প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গানে -সুরে ; তৈরি হয় “লোকবিচিত্রা” নামে একটি লোকগানের দল যা দেশের মধ্যে প্রথম আকাশবাণীর “এ” গ্রেড তালিকাভুক্ত গানের দল । পরবর্তী কালে কালিকা এই দলের নিয়মিত সদস্য হয় । অতএব কালিকা আশৈশব যাঁদের কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে, বা যে পরিবেশে অতিবাহিত হয়েছে তার কৈশোর এবং যৌবনের শুরুর কিছু কাল, সেই সাংগীতিক আবহ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার । সুতরাং প্রথমে তবলিয়া হিসেবে সঙ্গীত জগতের আঙিনায় পা রাখলেও , সময়ের সঙ্গে যে সোপান গুলো সে পেরিয়ে গিয়েছিল নিজের অধ্যবসায় এবং আত্ম প্রত্যয়কে ভর করে , তা তার জীবন কে পৌঁছে দিয়েছিল এক উচ্চতায় যার নাগাল পাওয়া বড় সহজ কথা নয় ।

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর এই পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির পিছনে আরেকটি কারণ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অনায়াস গতি । ১৯৯২ থেকে ৯৩ অর্থাৎ কলকাতায় চলে আসবার আগে অবধি সমান্তরালে সে করে চলেছে নানা ধরণের সৃষ্টি ধর্মী কাজ কর্ম । একের পর এক কবিতা, গান লিখেছে, বন্ধুজনদের নিয়ে বার করেছে লিটল ম্যাগাজিন , পথ নাটক করেছে , বিতর্কসভায় অংশ গ্রহণ করে নিজের শাণিত যুক্তি দিয়ে ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে বিপক্ষের চক্রব্যূহ !! পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে তার পরিচয় ঘটেছে প্রাচ্য – পাশ্চাত্যে সাহিত্যের এক সুবিশাল সম্ভারের সঙ্গে । সে পেয়েছে কিছু প্রথিতযশা মানুষকে তার শিক্ষক হিসেবে । সুতরাং এক অর্থে প্রদীপের সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই  । আর সে প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়েছিল  ১৯৯৯ সালের এর এক সন্ধ্যায় যেদিন       “দোহার” তাদের লোক গান নিয়ে হাজির হয়েছিল কতিপয়  শহুরে দর্শকের সামনে ।

“দোহার’ ২০০০ সালে তাদের প্রথম অ্যালবাম “বন্ধুর দেশে” প্রকাশ করে। এটি ছিল বাংলা লোকগানের একটি সংকলন যেখানে প্রতিটি গান একটি ভিন্ন গায়কী বা ঐতিহ্যের প্রতিনিধি অথবা  কিছু বিখ্যাত পদকর্তার রচনা। অ্যালবামটির শুরু একটি বন্দনা গান দিয়ে, যা ছিল কালিকার কলমে । এর আগে লোকগীতি বা পল্লিগীতি সাধারণত শোনা গেছে একক গায়নে ।  কিন্তু “দোহার”   দলবদ্ধভাবে ভাবে সেই গান উপস্থাপনা করে  শহুরে শ্রোতা এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে একটি সেতু তৈরি করতে শুরু করল অচিরেই।

আরেক দিক থেকে দোহারের আবির্ভাব খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় । আসলে ঐ সময়টা  বাংলা গানের একটা সন্ধিক্ষণ বলা যেতে পারে । প্রথমত রবীন্দ্র কপিরাইট শেষ হয়েছে ২০০১ সালে –  সুতরাং রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে শুরু হয়ে গেছে না না ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা , কাঁটা ছেঁড়ার পালা । পুরনো বাঙলা আধুনিকের রিমেক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে বেশ কিছু নতুন শিল্পীকে , এসেছে “জীবনমুখী গান” আর তার সঙ্গে বাংলা ব্যান্ড । এরকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে নিঃসন্দেহে “দোহার” জন্ম দিতে পেরেছিল এক  নতুন সুর মূর্ছনার যা  নির্ভেজাল  এবং  সতেজ দেশজ সংস্কৃতির মেঠো গন্ধে ভরা ।  লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম, পিয়ার শাহ, দুর্বিন শাহ, দ্বিজদাস, মনোমোহন দত্ত, পুলিন চাঁদ  এরকম অনেক গীতিকারকে তারা পরিচয় করিয়ে দিয়েছে  শহুরে  শ্রোতা  দর্শকদের  সঙ্গে । কখনও বুঝিয়েছে  বাউল গানের দার্শনিক সংশ্লেষ , কখনও বা সা্রির সাথে ভাটিয়ালির তফাৎ অথবা  ছোটনাগপুরিয়া ঝুমুর থেকে চা বাগানের গানের রূপান্তর ।  এর কৃতিত্ব অবশ্যই টিম স্পিরিটের সামগ্রিকতায় বিশ্বাসী কালিকাপ্রসাদ  ।

কালিকার আরেক পছন্দের মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর রচনার মাঝে লোকসঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও কালিকার ভাবনা চিন্তা যেমন ছিল সুগভীর তেমনই কিছু জায়গায় রবি ঠাকুরের চিন্তা ভাবনাকে সে প্রশ্ন করবার সাহস দেখিয়েছে । লালন সাঁই এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কী সমীকরণ, “বাউলাঙ্গের” সুরের আসল প্রকৃতি কি অথবা দেশাত্মবোধক গান / কবিতার বইয়ের নামকরণ “বাউল” কেন ,  দু’ধরনের গানের ভাব, কথা, সুরের মিল – অমিল কোথায় –   এই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কালিকাপ্রসাদ গড়ে তুলেছে এক অসামান্য ভাষ্য। লোক নাট্যের আঙ্গিকে গানে, সংলাপে, অভিনয়ে তৈরি হয় ‘আজব কুদরতি’ ২০০৯ সালে “দোহার” এর উপস্থাপনায় । বন্ধু ময়ূখ মৈনাক কে সঙ্গী করে কালিকা তৈরি করেছিল “মোকাম” যার একটিই অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছিল – “অযান্ত্রিক“ ১৯৯৫ সালে যাকে সাংগীতিক পরিভাষায় শুধু “ফিউশন” বললে অন্যায় হবে । প্রত্যেকটি গান হয়ে উঠেছে এক একটি বর্ণিল ক্যানভাস যেখানে দেশজ, বিদেশী গানের সুর কথা মিলে মিশে এক হয়ে গেছে । ধরা যাক “ভালবাসার পদাবলী” গানটি । ওপার বাংলার কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এর লেখা “ আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি”।  আনকোরা এক ভালবাসার গানের সঙ্গে মিশে গেছে বৈষ্ণব পদাবলী আর কামরূপী লোকগানে  রাধা কৃষ্ণ প্রেমের কথা ।  অথবা “সালাম” – যা চার্চের প্রার্থনা সঙ্গীতের মূর্ছনা বেয়ে  জানায় পৃথিবীর দুঃখ হতাশার মাঝে “ভালবাসার সালাম” । গানের সঙ্গে কখনও  মিশেছে  সুকুমার রায়ের ছড়া অথবা শুভ্র  প্রকাশ দাসের লেখা এক খণ্ড কবিতা “শব্দ তুই শূন্য মেঘের ঢেউ , চড়া ,বালি,পথিক –  শব্দ তুই রহস্যময় কেউ” ! তালি , তুরি , মুখ  নিঃসৃত ধ্বনি, তালের বোল,  গাল বাদ্য তৈরি করেছে এক অনবদ্য আবহের ।

See Also
কলকাতা

কালিকার সাংগঠনিক ক্ষমতার সাক্ষ্য “সহজ পরব “ এর আয়োজনে । রাজ্য , জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পীদের সমন্বয়ে কলকাতা শহরের বুকে এ যেন এক কার্নিভাল স্বরূপ । এর সঙ্গে জুড়ে আছে এক গভীর প্যাশন এবং গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কাজ করবার প্রত্যয় ।

“দোহার” এর বর্তমান সদস্য সুদীপ্ত  তার মামা কালিকা সম্পর্কে অনেক কথা বলে । “আমি তখন পণ্ডিত কুমার বসুর কাছে তবলার তালিম নিই ; মাঝেসাঝে কলকাতা আসা হয় । বরাবরই দেখেছি আমায় একটা স্পেস দিত ও । অনুষ্ঠানে অথবা স্টুডিয়োতে যেতে হত তার নির্দেশ মেনে – গিয়ে হয়ত বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই । কিন্তু ঐ পরিবেশটাই ক্রমশ পেয়ে বসেছিল আমায় । কলাকুশলী , যন্ত্র বাদক যাদের সঙ্গে আজ কাজ করি – তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গেছিল সেই বয়সেই । আসলে সে  ছিল আমার দ্রোণাচার্য আর আমি তার একনিষ্ঠ একলব্য“।

আজ আরেক ১১ই সেপ্টেম্বর । পৃথিবীর কাছে এই দিন্ এক ভয়াবহতার স্মৃতি বয়ে আনে । মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল ২০০১ সালে । কিন্তু  এই দিন বন্ধু কালিকার জন্মদিনও বটে । যে কালিকা তার কথায় , গানে , কবিতায় , সংলাপে মুছতে  চেয়েছে দেশের সীমানা , জুড়তে চেয়েছে মানুষের হৃদয় । তাই কালিকা তোমার জন্মদিনে  “তুমি  এসো ফসলের ডাকে , বটের ঝুড়ির ফাঁকে আর এস স্বপ্নঘুমে , ভালবাসা করে আশা তোমার অতল জল , শীতল করবে মরুভূমি “!

(লেখার সুত্র সুদীপ্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে এক আলাপচারিতা এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা )

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top