কলকাতা-লাদাখ সোলো রাইড, অভিষেক এর স্বপ্নের লড়াই, এসো কিছু করে দেখাই



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
অজানা ভয়, অচেনা আশঙ্কা এই নিয়ে বাঙালি বেঁচে থাকে না। বাঙালি হারতে শেখেনি, কখনো হারে না। বাঙালি জয়ের পতাকা উড়িয়ে চলে। সেই রকম এক জেতার গল্প। অভিষেক দে, একা ছাব্বিশ দিন, হাজার প্রতিবন্ধকতা, কখনও বৃষ্টি, কখনও তুষারপাত, অপ্রতুল অক্সিজেন – সব বাধা অতিক্রম করে, কলকাতা-লাদাখ সোলো রাইড, বলেছেন নিজের স্বপ্ন জয়ের এক্সপিডিশনের গল্প। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী।
বাঙালি কখনো হারে নি, হারে না, হারতে শেখে নি। বেশ কয়েক মাস আগে এক বাঙালি ছেলের কথা লিখেছিলাম এই কলমে। “একলা-চলো-রে“। কোনোরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই একা, সম্পূর্ণ একা চলে গিয়েছিলো ‘এভারেস্ট বেস ক্যাম্প’। আজ তার আর এক এক্সপিডিশনের গল্প বলি। যখন কিছু ঘটে, সেটা ঘটনা – পরে সেটা গল্প হয়ে যায়। অভিষেক, অভিষেক দে, যাকে সবাই আরিয়ান বলে চেনে, সেই রকম এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে গত বছর জুন মাসে। আরবী শব্দ ‘আরিয়ান’ এর অর্থ ‘সোনালী জীবন’।
দীর্ঘ সাত মাস ধরে নানারকম পড়াশোনা এবং ইউটিউবের কোনরকম সাহায্য ছাড়া, নিজের যাত্রাপথ নিজে বানিয়ে, একটা স্কুটিকে ভরসা করে বেরিয়ে পড়া বোধহয় কলকাতার সোদপুরের অভিষেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব।
একটা সাধারণ স্কুটি, যার অয়েল ট্যাঙ্ক ক্যাপাসিটি মাত্র পাঁচ লিটার। স্কুটীর দুপাশে দুটো পেট্রোল জারিকেন, সঙ্গে টেন্ট, শুকনো খাবার, ট্রেকিং স্টোভ, গ্যাস ইত্যাদি নিয়ে যাত্রা শুরু। কলকাতা থেকে বেনারস, আগ্রা, আম্বালা, মানালি – এটা প্রাথমিক যাত্রাপথ। এবার শুরু আসল লড়াই।
মানালি থেকে বেরিয়ে ‘সবুজে সাজানো তোমার দেশ’ সোলাং ভ্যালি, শীতে বরফের চাদর জড়িয়ে শীত ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়, পাশে রেখে অটল টানেল। প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার দীর্ঘ অটল টানেল পেরিয়ে শিশু, ১০২৩৬ ফুট উঁচুতে চেনাব নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে একা থাকা। যাকে ট্রেকিং এর পরিভাষায় বলে সোলো ক্যাম্পিং। দূর দূর অবধি কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না। প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে দিয়ে একা, একদম একা থাকা। সঙ্গে ঠান্ডা হওয়ার দাপট, বৃষ্টি।
ভাগা ও চন্দ্রা নদীর ধারে কিলং (১০৮৬০ ফুট), পথে ‘জিস্পা’ – অপূর্ব বললে কম বলা হবে। বারালাশা লা পাস পেরিয়ে ‘দীপক তাল’ কে পাশে রেখে এগিয়ে চলা। বরফ, শুধুই বরফ। আর্মি, বরফ কেটে রাস্তা করে রেখেছে তার মধ্যে দিয়ে চলা। তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির চেয়ে কম, সেটা বলে দিতে হয় না। ‘সুরজতাল’ The third highest altitude lake of the country. চোলামু ও গুরুদম্বার – প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে এবং দুটোই সিকিমে।
নাকি লা পাস (১৫৫৪৭ ফুট) পেরিয়ে, প্রতিকূল আবহাওয়াকে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে, স্কুটি চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কখনো দ্রোন উড়িয়ে, কখনো ক্যামেরাতে সেইসব ছবি তুলে রাখা। নাকি লা পাসের পর রাস্তা ভীষণ খারাপ। লা চুংলা (১৬৬১৬ ফুট)।
লে যাবার রাস্তাটি খুব সুন্দর। পিচ কালো টানা রাস্তা, দুধারে রুক্ষ পাহাড়ের প্রান্তর, এক অন্যরূপ। অনেকেই এই রাস্তায় বসে, শুয়ে – নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। মোরে প্লেন। যার আসল নাম কিয়াং চু থাং। স্থানীয় ভাষায় সঠিক অর্থ ইংরেজিতে বললে বলতে হয় ‘A place where Tibetan wild ass does not find water’. আরো এগিয়ে চলা, মেরু (১৬৯০০ ফুট)। এবার পেরোতে হবে টাগলাং লা (১৭৪৮২ ফুট)। এখনো বাকি আরো উঁচুতে চড়া। অবশেষে খারদুঙ্গ লা পাস। যেখানে জুন মাসেও চলেছে তুষারপাত। তাপমান মাইনাস ১০ ডিগ্রি।
এবার নিচে নামার পালা। নুব্রা, ধুধু প্রান্তরে নুব্রা নদীর তীরে আবার একা টেন্ট খাটিয়ে রাত্রি বাস। পরদিন চলে যাওয়া ‘সিয়াচিন বেস ক্যাম্প’। একদিকে চীন, অন্যদিকে পাক্ অধিকৃত কাশ্মীর, সামনে বিশাল সিয়াচিন হিমবাহ। এইখানে, অতি প্রতিকূল আবহাওয়াতে, সারা বছর, অতন্দ্র প্রহরায় আমাদের বীর জাওয়ানরা। শীতে এখানে তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রি। এখান থেকে প্যাংগং লেক।
3idiots সিনেমার শেষ দৃশ্য মনে আছে? একদল ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আমির খান একটা লেকের ধারে খেলনার এরোপ্লেন ওড়াচ্ছেন। সেই টলটলে নীল জলের লেক, ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে চলেছে। হাওয়ার ধাক্কায় লেকের জলে খুব ছোট ছোট ঢেউ পাড়ে এসে ঢেউ ভাঙার গান, ‘ছলাৎ-ছল, ছলাৎ-ছল’ শুনিয়ে যাচ্ছে। এটা সেই লেক।
এবার নিচে নামার পালা। ইউটিউব চ্যানেল Final Destination এ পুরো অ্যাডভেঞ্চারের ছবিটা ধরে রেখেছেন অভিষেক। সবার জন্য, সবার দেখার জন্য।
মনের ইচ্ছে থাকলে, থুড়ি মনের জোর থাকলে সব সম্ভব। অনেকেই দুই চাকায় লে লাদাখ যান, তবে বাইকে। ভারি ভারি বাইক নিয়ে। আরিয়ান স্কুটিতে। বাইকের অয়েল ট্যাংক অনেক বড়, স্কুটির মাত্র পাঁচ লিটার। ডর কে আগে………স্রেফ জিৎ নেহি হার ভি হ্যায়। আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি জিততে চান, না হারতে !?
অভিষেক (আরিয়ান) দে একটা কথা প্রমাণ করে দিয়েছেন। যারা লড়াই এর ময়দান ছেড়ে চলে যায়, তারা কখনোই যেতে না। আর যারা জিতে যায়, তারা কখনোই লড়াই এর ময়দান ছেড়ে পালায় না। “Winners don’t quit, quitters don’t win.”
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.