Now Reading
কলকাতার মেসবাড়ি

কলকাতার মেসবাড়ি

Avatar photo
কলকাতার মেসবাড়ি

আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা। কিন্তু বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে আধুনিকতার ঢেউয়ে পুরনো অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শহর থেকে। তারই মধ্যে একটি হলো  কলকাতার মেসবাড়ি । একটি প্রতিবেদন রইল পাঠকদের জন্য রাজকুমার মুখার্জির কলমে।

 

কলকাতার বুকে পুরানো অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ঢেউ চাকচিক্যের গহ্বরে গিলে খাচ্ছে স্মৃতি বিজড়িত ভদ্রাসন, দালান, বাড়ি। নবরূপে তিলোত্তমাকে সাজাতে, পুরনো কে বস্তাবন্দি করে ভাসিয়ে দিয়েছি কালের সাগরে। কলকাতার মেসবাড়ি সেই রকম একটি বস্তাবন্দি স্মৃতি। উত্তর কলকাতার কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট, হ্যারিসন রোড (অধুনা মহাত্মা গান্ধী রোড), শিয়ালদা, মানিকতলা, বউবাজার ছিল মেসবাড়ির আড্ডা। যে কয়েক খানা আজও টিঁকে আছে, তাদের অবস্থা সঙ্গীন। সদর পেরিয়ে অন্ধকার ঘুপচি গলি, ভাঙ্গা সিঁড়ি, সিঁড়ির রেলিং কোথাও আছে কোথাও নেই, অপরিচ্ছন্ন দেওয়াল। সে দেওয়ালে চুনকাম হয় না বহু কাল। ঘরের দেওয়ালে হ্যাঙ্গারে টাঙানো জামা প্যান্ট। ঘরের ভেতর পাতা দু তিনটে তক্তাপোষ। বাড়ির গায়ে পলেস্তারা খসে গিয়ে পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়ার মতন ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। বট অশ্বত্থ গাছের ঝুরি নেমে এসেছে দেওয়ালের গা বেয়ে। লোহার জাফরি কাটা রেলিংয়ের বেশিটাই উধাও। কোন কোন বাড়ির গায়ে ‘সাবধান বিপদজনক বাড়ি’ নোটিশ সাঁটা। কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে বহু গল্প।

সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। নব্য যুবকেরা বাংলার গ্রাম গঞ্জ থেকে কলকাতায় কাজের খোঁজে এসে মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজতেন এই মেসবাড়িগুলোতে। উত্তর কলকাতার ওইসব অঞ্চলে মেসবাড়ি গড়ে ওঠার পেছনে কারণ ছিল কাছেই স্কুল, কলেজ, অফিস, কাছারি। দিনের শেষে বাড়ি বলতে ছিল সেই কলকাতার মেসবাড়ি। একসঙ্গে বহুদিন একই ছাদের তলায় কাটাতে কাটাতে এঁরা একে অপরের আত্মীয় হয়ে যেতেন। একে অন্যের সুখে দুঃখের ভাগীদার হতেন। সকালে কলঘরের ঝগড়া কখনো সন্ধ্যায় রেডিওতে ‘অনুরোধের আসর’ শোনা বা তাস খেলায় ব্যাঘাত ঘটাতো না। ছিল গাঢ় বন্ধুত্ব।
বাংলার বহু বরেণ্য এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকের কলকাতায় প্রথম বাস মেসবাড়িতে। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং এর জানালা দিয়ে রাস্তায় চলা ট্রাম দেখা একটা নেশা ছিল। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু বছর মেসবাড়িতে কাটিয়ে গেছেন। বাংলা হাস্যরস গল্পের পথিকৃত শিবরাম চক্রবর্তীর কলকাতার ঠিকানা ছিল মেসবাড়ি। ক্ষেত্র কুঠি, ১৩৪ মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট। চাঁচোল রাজ পরিবারের সন্তান হয়েও অতি সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন শিব্রাম চক্কোত্তি মশাই। ব্যবহার করতেন দুটি ধুতি। একটি পরতেন, অপরটি ধোপার বাড়িতে কাচতে দিতেন। বদলানোর দরকার হলে ধোপার বাড়ি গিয়ে বদলে আসতেন। সারাদিন মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের মেসে থাকতেন। মেসবাড়ির নিজের ঘরের দেওয়াল রং করতে দিতেন না। দেওয়াল জুড়ে থাকতো ঠিকানা লেখা। বলতেন ঠিকানা খাতায় লিখি না, খাতা হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দেওয়াল তো হারাবে না।
এহেন শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে চোরের একটি মজার ঘটনা বলি। একবার এক চোর চক্রবর্তী মহাশয়ের মেসবাড়ির ঘরে চুরি করতে ঢুকেছে, শিবরাম বাবু ঘরে নেই। চোর ঘরে ঢুকে অবাক, নেবার মতন কিছুই নেই। চোর কিছু না নিয়েই চলে গেল। শিবরাম চক্রবর্তী মহাশয় ঘরে ফিরে এসে দেখেন তার তক্তাপোষের উপর একটি দশ টাকার নোট সঙ্গে একটি চিরকুট। চিরকুটে লেখা ‘ঘরে নেবার মতন কিছুই পেলাম না। দশ টাকা রেখে গেলাম ধুপকাঠি কিনে ফেরি করুন।’
শিবরাম চক্রবর্তী বাবু রাবড়ি খেতে খুব ভালবাসতেন। বলতেন নেশা করতে হলে রাবড়ির নেশা করাই ভালো। একমাত্র রাবড়ির লোভেই মেসবাড়ীর তক্তাপোষ ছেড়ে বাইরে বেরোতেন। মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের সেই মেসবাড়ি আজ অতি জীর্ণদশাগ্রস্ত অবস্থা। বর্তমানে তালা ঝুলছে। যখন এই লেখা আপনি পড়বেন, তখন হয়তো গাঁইথি, হাতুড়ি দিয়ে সে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেছে। “মুক্তারাম থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়ে……..” এ স্মৃতি মুছে যাবে চিরতরে।

মেসবাড়ির সঙ্গে শুধু লেখক কেন, খেলোয়ারদেরও একটা যোগাযোগ আছ। বিখ্যাত ফুটবলার পিকে ব্যানার্জি, জামশেদপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রথম জীবনে মেস বাড়িতে থাকতেন। তখন তাঁর বয়স বড়জোর সতেরো কিম্বা আঠারো। আজকের ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহা অশোক দিন্দা – এঁরা প্রথম জীবনে বেশ কিছুদিন শিয়ালদা কোলে মার্কেটের মেসে কাটিয়েছেন। ভালো খেললে বা সেঞ্চুরি করলে রাতে মুরগির মাংস আর ভাতের ফিস্টি বরাদ্দ থাকতো। সত্তরের দশকে মোহনবাগান বা মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ইলিয়ট রোডের মেস ছিল বিখ্যাত। কলকাতা মাঠের বহু বিখ্যাত ফুটবলারের আস্তানা ছিল ইলিয়াট রোডের মেস।
ষাটের দশকে বাংলা সিনেমা ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ প্রভৃতি মেসবাড়িকে কেন্দ্র করে। আসলে ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ একসময় ছিল এই কলকাতার মেসবাড়ি। কালের যাত্রায় মেসবাড়ি হারিয়ে গেছে, এসেছে পিজি। তক্তাপোষ এখন সিঙ্গেল বেড। একসাথে, এক ছাদের তলায় থেকেও আগের মতন আর এক পরিবার নেই। সবাই ভিন্ন ভিন্ন এক একটি দ্বীপ।

See Also

কর্মসূত্রে দেশের পশ্চিম, দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্বের বহু শহরে বেশ কয়েক বছর কাটাতে হয়েছে। কলকাতা ছাড়াও বহরমপুর শহরে খাগড়া, গোরাবাজার, জজকোট ইত্যাদি অঞ্চলে মেসবাড়ির চল রয়েছে। দক্ষিণের চেন্নাই শহরে থিরুভেলিকেনী অঞ্চলে ঠিক মেস নয়, অনেকটা বোর্ডিং হাউসের মতন ম্যানসন দেখেছি। যেখানে শুধু থাকা যায়। ঝাড়খণ্ডের রাঁচী শহরে ডোরান্ডা, কার্দু বা ক্যাপিটল মলের পেছনে কিছু কিছু বোর্ডিং হাউস আছে; তবে কলকাতার মেসবাড়ির মতন একসঙ্গে মিলেমিশে একই পরিবারের সদস্য হয়ে থাকার মজা বোধহয় অন্য কোথাও নেই।

পাঁচ দশ বছরের মধ্যে হয়তো কলকাতায় ধিক্ ধিক্ করে বেঁচে থাকা মেসবাড়িগুলো ভেঙে বড় বড় ইমারত গড়ে উঠবে। হারিয়ে যাবে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। পরের প্রজন্ম হয়তো পড়বে শরদিন্দু, জীবনানন্দ, শিবরাম। কিন্তু এঁদের প্রথম জীবনে সাহিত্য সৃষ্টির পীঠস্থান খুঁজে পাবে না।

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
3
In Love
1
Not Sure
1
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top