কলকাতার ফ্যান্সি লেন
A physics teacher who is also a passionate traveller and…
কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা এবং গলি গুলোর অনেক ইতিহাস আছে। এমনই ইতিহাস তুলে ধরছেন লেখক তার এই নতুন সিরিজে। আজ জেনে নিন কুখ্যাত ফ্যান্সি লেন নিয়ে যেখানে চুরি, উপহাস ইত্যাদির মত খুব ছোট অপরাধের জন্য ইংরেজি শাসকরা ফাঁসির সাজা শোনাতেন ।
লেখা ও ছবি আবির ভট্টাচার্য
ঘড়ি চুরির দায়ে ফাঁসি! তাও আবার প্রকাশ্য জনপথে, রীতিমতো ধেড়া পিটিয়ে লোকজন জোগাড় করে ঘটা করে গলায় দড়ি পরিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল গাছের ডালে। আর কোথায় এইসব হত জানেন ? রাজভবনের ঠিক উল্টো দিকের গলিতে, যার নাম ফ্যান্সি লেন। নামটা শুনে ফ্যান্সি লাগলেও এই ফ্যান্সি কথাটা কিন্তু এসেছে ফাঁসি থেকেই। ব্রিটিশরা তো ফাঁসি উচ্চারণ করতে পারত না, তাই বলতো ফ্যান্সি।
কিন্তু সে কথা যাক, ফিরে আসি আমাদের গল্পে। ঘুড়ি চুরির জন্য ফাঁসি তো হল জনৈক ব্রজমোহন রায়ের, কিন্তু সেই ঘড়ির দামই বা কত যার জন্য ফাঁসি হয়। দাম শুনলে অবাক হয়ে যাবেন – মাত্র ২৫ টাকা। কিন্তু সালটা হল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, সেই হিসেবে দেখতে গেলে ওই সময় ২৫ টাকার মূল্য অনেকটাই। কিন্তু মূল্য যাই হোক, সামান্য ঘুড়ি চুরির দায়ে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে দেবে, দেশে কি কোন আইন কানুন নেই? হ্যাঁ আছে বৈকি, শুধু আইন কেন, আছে বিভিন্ন ধরনের কোর্ট, পিপলস কোর্ট, কোর্ট অফ অ্যাপিল, মেয়রস কোর্ট ইত্যাদি। এমনকি ওই সময় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়েছিল এবং হয়েছিল এই কলকাতাতেই।
ব্রিটিশ রাজত্বের আগে অবশ্য সেই অর্থে বিচার ব্যবস্থার কোন সঠিক মান ছিল না। মুসলমানদের জন্য ছিল কাজীর বিচার, আর হিন্দুদের ছিল স্থানীয় জমিদার বা মোড়ল জাতীয় ব্যক্তিদের কাছে বিচার। ব্রিটিশ রাজ ভারতে আসার সাথে সাথেই এলো উন্নত দেশের উন্নত শাসন এবং আইন ব্যবস্থা। যদিও সেই ব্যবস্থা আদতে কতটা উন্নত ছিল সেটা বিচার সাপেক্ষ। নইলে হয়তো ঘড়ি চুরির দায়ে ফাঁসির মতো লঘু পাপে গুরুদন্ড হতো না।
যেমন ধরা যাক পিপলস কোর্ট, নাম শুনে জনসাধারণের বিচারালয় বলে মনে হলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু এর অঙ্গ ছিলেন না। এর পিছনে থাকতো স্থানীয় জমিদার ব্রিটিশ অফিসার এবং তাদের মোসাহেবরা। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্ল্যাক টাউনের বাসিন্দাদের জন্য বরাদ্দ ছিল লঘু পাপে গুরু দন্ডের আদেশ। চুরি ছিনতাই রাহাজানি সব কিছুরই একমাত্র শাস্তি ছিল ফাঁসি। তাও উপযুক্ত ফাঁসির মঞ্চ করেও না, ফ্যান্সি লেনের বড় বড় গাছগুলি থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হতো তাদের।
এখন কথা হল এত জায়গা থাকতে হঠাৎ ফ্যান্সি লেন কেন, এমন কি আছে ওখানে। তা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েকটি বছর। এখন যেখানে ফ্যান্সি লেন, ব্রিটিশরা আসার আগে সেখানে ছিল বড় বড় গাছের জঙ্গল, আর তার মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত একটি ছোট নদী, ওয়ারেন হেস্টিংসের নাম অনুসারে পরে যার নামকরণ করা হয়েছিল হেস্টিংস রিভার। যদিও ভবিষ্যতে এই নদী বুঝিয়ে বানানো হয় হেস্টিংস স্ট্রিট।
সে যাই হোক, এই হেস্টিংস নদীর উল্টোদিকে ছিল একদল দস্যুর বাস, ইতিহাসে যারা পরিচিত কুখ্যাত ঠগী নামে। এরা নির্জনে লুকিয়ে থাকতো জঙ্গলের ভিতরে, আর একলা মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের সর্বস্ব লুট করে নৃশংসভাবে খুন করত, তারপর তাদের লাশও গুম করে দিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আসার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার নব্য অফিসাররা হয়ে উঠেছিল এই ঠগীদের খুব সহজ শিকার। তাই কোনোভাবে যদি এদের একজন কেও ধরা হতো, তাহলে রীতিমতো ঢ্যাঁড়া পিছিয়ে লোক ডেকে প্রকাশ্য দিবালোকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হতো এদের। যাতে বাকিরা কোম্পানির অফিসারদের উপর আক্রমণ করতে ভয় পায়। এই থেকেই ফ্যান্সি লেনে ফাঁসি দেওয়ার চল।
স্থানীয় গরিব মানুষদের সাধারণ অপরাধের জন্য শোনানো হতো ফাঁসির আদেশ। অবশ্য চাইলেই তারা আপিল করতে পারতো হায়ার কোর্টে। কিন্তু সেই আপিল করতে যে পরিমাণ খরচ, তা যোগানোর থেকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নেওয়া অনেক বেশি সহজ।
ইতিহাসে আরও একটি বিখ্যাত ফাঁসি হয়েছিল কলকাতায়। মহারাজা নন্দকুমার এর ফাঁসি। তিনি অবশ্য জমিদার মানুষ ছিলেন বলে অনেক দূর অব্দি আইনি লড়াই করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেষ ব্রিটিশদের চক্রান্তে তার ফাঁসি হয়। যদিও তা ফ্যান্সি লেনে হয়নি, হয়েছিল অন্য জায়গায়। সেই সম্পর্কে বলব পরবর্তী পর্বে।
এই ফ্যান্সি লেনের উপর একটি ভিডিও বানানো হয়েছে, সেখানে ফ্যান্সি লেনের অবস্থান এবং যাবতীয় তথ্য পাবেন। ভিডিও লিংক নিচে দেওয়া রইল…
What's Your Reaction?
A physics teacher who is also a passionate traveller and photographer, spends his time reading fictional books and watching movies. Abir's unique perspective, combined with his expertise in Physics, adds depth and complexity to his photographic work.