একলা চলো রে……
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
বাঙালিকে সবাই ভীতু বলে, হেয় করে, আজ এমন একজন বাঙালির গল্প বলবো, যে বাঙালি একাই কোনরকম ট্রেনিং ছাড়াই চলে গেছে মাউন্ট এভারেস্ট বেসক্যাম্প, এটা ভাবা যায় না । আসুন সেই ‘একলা চলো রে’ গল্পটা শুনি রাজকুমার মুখার্জির কলম থেকে।
মাছ-ভাতের বাঙালি, সবাই বাঙালীকে ভীতু বলে। নকশাল নেতা চারু মজুমদারের পরে নাকি সাহসী বাঙালি আর দেখা যায় নি। বাংলা নববর্ষের দিনে, ‘দাদাগিরি’ কে হারিয়ে আজ এক সাহসী বাঙালির ‘একলা চলো রে’ গল্প বলি। নাম অভিষেক দে, বন্ধুরা ভালোবেসে বলে আরিয়ান। আরিয়ান শব্দের আরবি অর্থ হল ‘সোনালী জীবন’। সেই সোনালী জীবনের একটা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমি হলফ করে বলতে পারি, ‘একলা চলো রে’ অভিষেকের সাহসের কথা পড়ে আপনি শুধু তাজ্জব বনে যাবেন না, বাঙালি হয়ে আপনার বুকের ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাড়িয়ে যাবে।
অভিষেক দে, বর্তমান বয়স ৩৩। ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যার মুকুটের একটি পালক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মী, ঘুরে বেড়ানো যার নেশা। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে স্কাই ডাইভিং করে উপলব্ধি করেছেন ২০-২৫ হাজার ফুট উপরে প্লেন থেকে পৃথিবীর বুকে ঝাঁপ দিতে কেমন লাগে। এবারে চলেছেন মাউন্ট এভারেস্ট বেসক্যাম্প। মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্প তো অনেকেই গেছেন, তবে অভিষেকের সঙ্গে আর সবার তফাৎ কোথায়? অভিষেক এর আগে কখনো ট্রেকিং করেনি। এটাই তার জীবনের প্রথম ট্রেক। সান্দাকফু পীন্ডারি ট্রেকার এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। তাই বলে মাউন্ট এভারেস্ট বেসক্যাম্প — তাও কোন ট্রেনিং, গাইড, শেরপা, মালবাহক, এসব ছাড়া!! একলা, যাকে বলে সোলো ট্রেকিং!! Spectacular Record of Guinness World এ বোধহয় এই দুঃসাহ দেখিয়ে আজ অবধি কেউ নিজের নাম তুলতে পারেনি। এই রেকর্ডের দাবিদার অবশ্যই অভিষেক, এটাই ‘একলা চলো রে’। অভিষেকের যে নিজের মনে ভয় ছিল না, তা নয়। ভয় ছিল, কিন্তু ভয়কে জয় করাই তার স্বভাব।
আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোরির তরফ থেকে অভিষেকের সঙ্গে যোগাযোগ করি, একটা ইন্টারভিউ নিই, সেই সঙ্গে ভিডিও ও স্টিল ফটোগ্রাফ। আসুন শুরুর কথা এবার শুরু থেকে শুরু করি। ‘একলা চলো রে’ গপ্পো।
অভিষেক মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাবার তোড়জোড় শুরু করে সাত মাস আগে, এপ্রিল-মে মাস নাগাদ। নভেম্বর ২০২১ যাত্রা শুরু। এই সাত মাস ধরে কি প্রিপারেশন নিয়েছিল অভিষেক? প্রথম, Paper Work, সমস্ত তথ্য জোগাড় করা, অনুমতি পত্র জোগাড় করা, টাকার জোগাড়, রিজার্ভ ব্যাংকের পারমিট, ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় Mental Preparation নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করা। এই সময় অভিষেক নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে স্লিপিং ব্যাগ, ইকুইপমেন্ট, ক্যামেরা, পোর্টেবল সোলার প্যাড, পাওয়ার ব্যাংক, ইত্যাদি ইত্যাদি কিনে নেয়। নিজের টাকা খরচ করে ফেলেছি এবার আর ফেরার জায়গা নেই, যেতেই হবে। একে বলে নিজের কাছে নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। তৃতীয় Physical Training যাত্রা শুরুর একমাস আগে থেকে শুরু হল শরীরের কসরত করা। খুব সামান্য কিন্তু অসামান্য। নিজের বাড়িতে সিঁড়ি ভেঙে ওঠা নামা। প্রথমে দিনে ২০ বার তারপরে ২৫ বার তারপরে ৩০ বার তারপরে ৫০ বার এমনি করতে করতে ৮০ বার। এবার রুকস্যাকে নিজের জামা কাপড় ভরে ওজন বাড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙা শুরু।
অভিষেক কে সবাই জানে, কোন কিছু সিদ্ধান্তে আসার আগে পাঁচবার নয় ২৫ বার ভাবে। তারপর যদি মনে করে এটা করব, তাহলে আর পিছনে ফেরা নেই। সালমান খানের সিনেমার সেই ডায়লগটা মনে আছে ‘ম্যাঁয় একবার যব কমিট কার দেতা হুঁ তো খুদ কা ভি নেহি শুনতা’। এটাই দৃঢ় মানসিকতার পরিচয়।
মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যেতে গেলে নেপালের কাঠমান্ডু হয়েই যেতে হয়। ওখান থেকে ছোট প্লেনে যেতে হবে লুকালা-তেনজিং হিলারি বিমানবন্দর। The dangerous airport of the world। ছোট্ট রানওয়ে। রানওয়ের একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে গভীর খাদ। এখান থেকে মানজো, ২৮৩৫ মিটার (৯৩০২ ফুট) উচ্চতা। এখান থেকেই হাঁটা শুরু। রাস্তা বলতে সেরকম কিছু নেই। বন পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে পাথুরে পথ চলেছে। আছে বড় বড় সাসপেনশন ব্রিজ। স্থানীয় মানুষ আর খচ্চর, মালের বোঝা নিয়ে চলেছে। গ্যাস সিলিন্ডার, কেরোসিন তেল, কাঁচা সবজি, মাংস সব। রাতে এখানেই থাকা, কাল সকালে থেকে শুরু হবে আসল ট্রেকিং।
লুকালা থেকে মানজো – নামচিবাজার – তেংবোচে – ডিংবোচে। ডিংবোচে, উচ্চতা ৪৩৯৮ মিটার (১৪২৯৭ ফুট) অক্সিজেন অপ্রতুল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাপমান -৮ ডিগ্রি, সঙ্গে চলেছে ঠান্ডা ঝোড়ো হওয়ার দাপট। এইখানে একদিন থাকা। কারণ শরীরকে আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে, আশেপাশে কেউ নেই যার কাছে একটু সাহায্য চাওয়া যায়। মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে, খোলা আকাশের নিচে শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে, নিজেকে সুস্থ করা।
পরের দিন যাত্রা শুরু, গন্তব্য লাবুচে। রাস্তা ভীষণ খারাপ। প্রায় পুরো রাস্তাটাই চড়াই। খুব সরু রাস্তা, একপাশে গভীর খাদ অন্য পাশে পাহাড়ের দেওয়াল। একটু অসাবধান হলেই আর মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্প নয় একবারে সোজা স্বর্গে। পথে দেখা বহু পর্যটকের সঙ্গে। তারা সবাই বিদেশী এবং তাদের সঙ্গে রয়েছে মালবাহক অথবা গাইড। তারা কেউ একা আসেন নি। কমপক্ষে দুজন থেকে শুরু করে চার পাঁচ জনের দল। চলার পথে সবাই অভিষেককে তার সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে যেতে ভোলেন না। সবার দুহাতে দুটো করে ট্রেকিং পোল (পাহাড়ে চড়ার বিশেষ লাঠি) যাতে ভর করে তারা এগিয়ে চলেছেন। অভিষেকের সঙ্গে রয়েছে কেবল একটাই ট্রাকিং পোল, অন্য হাতে রয়েছে সেলফি স্টিক। পাউট করে নিজের ছবি তুলে ফেসবুকে দেওয়ার জন্য নয়, পুরো রাস্তার ভিডিও তুলে চলেছেন, লক্ষ্য আরো সবাইকে দেখানো, উদ্বুদ্ধ করা।
পিঠে রয়েছে মস্ত রুকস্যাক, যার ওজন প্রায় ১৬ কেজি, টুপিতে লাগানো আছে ক্যামেরা। কোথাও আবার বড় পাথরের ওপর ক্যামেরা বসিয়ে নিজের খাড়াই পথ পেরিয়ে যাবার ছবি তুলে, আবার ফিরে এসে ক্যামেরা নিয়ে গেছে। এক চড়াই দুবার করে চড়া। পুরো যাত্রা পথটার ভিডিও দেখলে বোঝা যায়, অভিষেক আর পাঁচটা ছেলের মতন জোয়ারে গা ভাসিয়ে জীবন কাটানোর ছেলে নয়, সবার থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র। নিজেই নিজের ব্র্যান্ড। যার কর্মকাণ্ড দেখে আপনাকে কুর্নিশ জানাতেই হবে।
৪৯৫০ মিটার (১৬২৪০ ফুট) উচ্চতার লবুচে থেকে চলা শুরু। এবারে যেতে হবে শেষ গন্তব্য – মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্প। পুরো রাস্তা ছোট বড় বোল্ডার টপকে যেতে হবে। একটু অন্যমনস্ক হলে পড়ে হাত পা ভাঙ্গা সম্ভাবনা ১০০%। গোরকশে – এখানে ব্যাগের ওজন কমিয়ে পায়ের যত্ন নিতেই হবে। অভিষেকের দুটো পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ডান পায়ের গোড়ালিতে ব্লাড ক্লট করেছে, যাকে বলে ফ্রস্ট বাইটের প্রথম ধাপ। বাঁ পায়ের ছাল উঠে গেছে। যে ছেলেটা জীবনে এর আগে কখনো ট্রেকিং করেনি, সে কি করে জানবে যে রাইডিং বুট আর ট্রাকিং বুট দুটো আলাদা। ট্রেকিংয়ের জন্য ট্রেকিং বুট দরকার হয়। রাইডিং বুট নিয়ে ট্রেকিং করা যায় না।
থেমে থাকার মানসিকতা নেই অভিষেকের মধ্যে। শুরু হলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলা। খম্বু গ্লেসিয়ার, অ্যাভালাঞ্জ – এসবকে সাক্ষী রেখে ৫৩৬৪ মিটার (১৭৬০০ ফুট) উচ্চতায় মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেছে। মাউন্ট এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের পাথরের উপর উঠে অভিষেক যখন নিজের ব্যাগ থেকে দেশের তেরঙ্গা পতাকা বার করে লম্বা লাঠিতে বেঁধে ওড়াচ্ছে, এ দৃশ্য দেখলে আপনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না। আপনার চোখে জল আসতে বাধ্য, নিজেকে গর্বিত মনে করবেন কারণ আপনি বাঙালি, অভিষেক ও বাঙালি। তারপর রাতের অন্ধকারে মোবাইলের আলোয় গোরকশে ফেরা, অভিষেকের এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
পরদিন কালাপাত্থর ৫৫৫০ মিটার (১৮২১০ ফুট) সামিট করে একা একা ফিরে আসছে সঙ্গে কেউ নেই, সেই ভিডিও দেখে, মনে একটা কথা বারবার তানপুরার সুরের মতো জেগে উঠে, একেই বলে মোটিভেশন। পৃথিবীতে কেউ কাউকে মোটিভেট করতে পারেনা, সম্ভব নয়। নিজেকে নিজে মোটিভেট করতে হয়।
এখানেই শেষ নয়। এরপরে আছে চোলাপাস। রাস্তায় নড়বড়ে পাথর, যার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। চড়াই আর চড়াই। অনেকটা টিকটিকির লেজ ধরে উপরে চড়ার মত। সেখানেই থেমে গেলে হবে না, একটা ছোট্ট ভ্যালি পেরিয়ে লম্বা একটা গ্লেসিয়ার। বরফের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে জল। ওপরের বরফ কিছু জায়গায় ঝুরঝুরে, একটু অসাবধান হলেই বরফ ভেঙে জলে। সেটা পার করতেই প্রায় ঘন্টাখানেক সময় চলে যায়। বিশাল গ্লেসিয়ারের মাঝে একা হেঁটে চলেছে অভিষেক। গন্তব্য চোলাপাস।
চোলাপাসের থেকে একটু নিচে ড্রাগনাগ। এখানে রাত কাটিয়ে সকালে আবার চলা শুরু, এবারের গন্তব্য গোকিও। পেরিয়ে যেতে হবে এক অচেনা, হাড়হিম করা, পথ হারিয়ে ফেলা গ্লেসিয়ার। পদে পদে বিপদ। বিপদের চাদর কে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকাই যেন অভিষেকের অভ্যাস।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ১৫ দিনের এই ট্রেকটা করতে অভিষেকের খরচ হয়েছিল প্রায় আশি হাজার টাকা। না কোন স্পন্সর ছিল না। ছিলনা কোন সরকারি সাহায্য। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, টাকার থলি নিয়ে সেলিব্রেটি ধরতে বের হয়। বাকি রইল সরকার, সরকারের এখন অমৃতকাল চলছে। এসব ছোট ব্যাপারে ব্যস্ত মাথা ঘামায় কি করে!! এতটা পড়ে আপনি হয়তো ভাবছেন সিকিমের গুরুদম্বার লেক ৫৪৩০ মিটার (১৭,৮১৫ ফুট), এখানে তো অনেকে যায়। নিশ্চয়ই যায়, তবে সেটা গাড়িতে। পায়ে হেঁটে নয়। ২৮৩৫ মিটার থেকে নয় দিন ধরে পায়ে হেঁটে ৫৫৫০ মিটার, কোন গাইড, মালবাহক, ট্রেনিং, এসব ছাড়াই-ভাবা যায়?!
বঞ্চিতেরা চিরকাল বঞ্চিত থেকেই যায়। প্রায় দু বছর হতে চলল, আজ অবধি একটা সম্বর্ধনা কেউ জানায়নি, তবুও এরা অবিচল, ‘একলা চলো রে’ এই মতেই বিশ্বাস করে। এরা ইতিহাস তৈরি করে যায়। পঞ্চাশ বছর পরে হয়তো কোন পর্বত আরোহন স্কুলে অভিষেকের ভিডিও দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করা হবে, self motivation এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ দেওয়া হবে।
অভিষেকের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলাম
“Either die with your dream or your memories. So don’t be afraid to dream big”.
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.
Aj apnader editorial page ei cover story dekhe jiboner hoyto sera puroskar peye gelam.. apnara sobai amr pronam neben.. East India Story creativity aro somosto lekha aro anek manus er kachhe pouchhanor mon theke kamona roilo.. Thank you Somashis sir.. Thank you Rajkumar Sir….
You’re an inspiration to many Abhishekh, we are proud to carry your story. We’re going to do something more with you in near future.Keep rocking like this.