একটি খেরো খাতার বৃত্তান্ত


সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের দ্বিতীয় বই ‘খেয়ালের খেরো খাতা’ প্রকাশিত হলো এই কলকাতা বইমেলায় । লেখক বইটিতে দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত উপাদানের সঙ্গে কল্পনা ও স্বপ্নের এক মিশ্রণ একত্রিত করেছেন। এই নিবেদনে বইটির উদ্ধৃতি রইল পাঠকদের জন্য।
‘খেয়ালের খেরো খাতা ‘ সপ্তর্ষি রায়বর্ধনের লেখা দ্বিতীয় বই । সবার আগে চোখ টানে দুটো জিনিস, বইটির নাম ও প্রচ্ছদ।অপূর্ব এর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ। অবিকল যেন সেই আমাদের ছেলেবেলার খেরোর খাতা।
এবারে বলি কেন এই খেরো খাতাটি খেয়ালের, সে বিষয়ে। লেখকের ভাষায়, এ খানিক কল্পনা আর খানিক স্বপ্নের মিশেল। আদতে এ হল খেয়ালী মনের এমন অনেক কথা যা রোজকার জীবনে মিলেমিশে থাকে, আমাদের বেখেয়ালে সেগুলো হয়তো অধরাই থেকে যায়। কিন্তু তিনি তো লেখক,তাই তাঁর ভাবনায়, তাঁর লেখায় চমৎকারভাবে ধরা দিয়েছে সে সব কথা আর কি সুচারু রূপে লিখেছেন তিনি পাঠকদের জন্যে।
সবচেয়ে বেশি টেনেছে এই বইটার সহজ আঙ্গিক। অত্যন্ত সহজ ও ঝরঝরে ভাষায় লেখা কিছু ঘটনাবলী, যার কিছু ঘটনা সর্বজনীন, অর্থাৎ তার সাক্ষী আমরা সবাই। যেমন ধরা যাক প্রথম গল্পটা।আবার কোনো গল্পে হয়তো চিরকালীন সম্পর্কের টানাপোড়েন।
আমাদের সবার জীবনে নানা সময়ে কিছু মজার মানুষ এসেছেন।হয়তো বা তিনি মামা, কাকা,মাসি বা দাদু। পাড়ার সকলের কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়, যাঁর কথায়, ব্যবহারে আট থেকে আশি সবাই হেসে কুটোপাটি হয়। সে নিজেও হয়তো তার সব কষ্ট লুকিয়ে ওভাবেই ধরা দিতে চান সবার সামনে! আমরা হয়তো তাঁদের দেখে কেবল মজাই পাই কিন্তু লেখকের কলমের মুন্সিয়ানায় অসাধারণ গ্রহণ যোগ্যতার সঙ্গে সেই গল্পগুলো ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে।
আমাদের ছোটবেলা জুড়ে ছিল সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল যার বেশিরভাগই এখন বন্ধ, কোথাও বা তার পরিবর্তে হয়েছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল; এই যে আমাদের ছোটবেলা একটু একটু করে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে,কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখতে পারছি না, এর জন্যে কে দায়ী, সময়, নাকি টেকনোলজি?সেইসব ফুরিয়ে যাওয়া সিনেমাহলের বিষয়ে লেখা ‘ এক পর্দার ধূসর ছবি ‘ পড়তে পড়তে যেমন অনেক অজানা তথ্য সামনে এল, তেমন মনটাও ভারাক্রান্ত হল বইকি! যেমন হল কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর বিষয়ে লেখাটা পড়তে পড়তেও। এই যে পাঠক একাত্ম হয়ে উঠছে লেখার সঙ্গে, এখানেই বোধহয় একজন লেখকের সার্থকতা।
এছাড়াও তাঁর কলমে উঠে এসেছে কখনো ছেলেবেলার স্মৃতি, কখনো হারিয়ে যাওয়া কোনো সম্পর্ক অথবা হারিয়ে ফেলা কোনো মুহূর্তের কথা। কখনো বা মনকে আমূল নাড়িয়ে দেওয়া কোনো ঘটনার থেকে প্রভাবিত হয়ে লিখে ফেলেছেন একটা ছোট গল্প, যে গল্প আমাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে। কখনো হয়তো লিখেছেন ‘পুরনো কলকেতার’ গপ্পো, যা তাঁর লেখার বাঁধুনিতে ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে চোখের সামনে। সমৃদ্ধও হয়েছি। আমাদের বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা, নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের ওঠাপড়া, টানাপোড়েন, বিশেষ ঘটনা বা মুহূর্ত, সামাজিক প্রেক্ষাপট,বদলে যাওয়া পটভূমি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এমনকি তাঁর পেশা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা দিয়েও ঝুলি ভরেছেন আর সেই ঝুলি থেকে একটা একটা পাথর বিছিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের সামনে।
কখনো একদম ব্যাক্তিগত কোনো সময়ের বা ঘটনার কথাও তো লিখেছেন, কিন্তু সেটা পড়তে অস্বস্তি তো হয়নি উপরন্তু নিজেকে বেশ মেলাতে পেরেছি তাঁর লেখার সঙ্গে। এসেছে তাঁর ভালবাসার কোনো সাহিত্যিক বা ব্যাক্তিত্বের কথাও।
গদ্য লেখার ক্ষেত্রেও লেখার একটা সহজাত ছন্দের ভীষণ দরকার পড়ে।ওঁর লেখার ক্ষেত্রে সেই ছন্দের অভাব ঘটেনি কখনো।আর যেটা পেয়েছি, সেটা হল মারাত্মক রসবোধ। এই সোজাসাপ্টা রসবোধ বোধহয় এখনকার লেখায় খুব কম দেখা যায়। অণুগল্প হলেও, গল্পের শেষটুকু জানবার ব্যাকুলতা থেকে যায় পাঠকের মনে। অনেকটা রহস্য উন্মোচনের মত।
সহজ করে, সহজ ভাষায় লেখা সবচেয়ে শক্ত কাজ।। আর সেই শক্ত কাজটাই করেছেন লেখক, অত্যন্ত সহজে। তাই আমার ধারণা এই লেখা পাঠকের মনকে নাড়া দেবেই দেবে। পাঠকের কাছে সমাদৃত হবেই তাঁর লেখা। আগামীর জন্য রইল অনেক শুভেচ্ছা, আরো এমন অনেক লেখার আশায় রইলাম।
” খেয়ালের খেরো খাতা” প্রকাশ পাচ্ছে ২০২৪ এর কলকাতা বইমেলায় ,”মায়া বুকস” থেকে । এখান থেকেই বেরিয়েছিল লেখকের প্রথম বই ” রূপকথার মতো – স্মৃতি কথায় প্রণতি রায় “