Now Reading
উঠলো বাই তো পুরী যাই

উঠলো বাই তো পুরী যাই

Avatar photo
উঠলো বাই,চলো যাই

সবাই জানেন, বাঙ্গালীর পায়ের তলায় সর্ষে। আর আমরা ঘুরতে যতটা ভালোবাসি, ঘোরার গল্প শুনতেও ততটাই ভালোবাসি। তাই বাংলায় ভ্রমণকাহিনী বেজায় জনপ্রিয়।

‘মনে আছে সেই বার পুরী…’

ছোট ছোট কাহিনীর সংকলন, কেকা বসু দেবের প্রথম ভ্রমণ বই “উঠলো বাই, চলো যাই” থেকে উদ্ধৃতাংশ রইল পাঠকদের জন্য।

আমার মামাবাড়ির মত আজব বাড়ি আপনি আর কোত্থাও পাবেন না, গ্যারান্টি ! ষাটের দশকে দিদিভাই যেখানে থাকতে শুরু করলেন, তাঁর ভাইবোনেরাও তাঁদের মাতৃসমা দিদির কাছাকাছি থাকার জন্য আশেপাশে পটাপট বাড়ি বানিয়ে ফেলল, ফলে নরক গুলজার ! ভোর পাঁচটায় মর্নিংওয়াকের নামে তাঁর বাপের বাড়ি, ভাসুরের বাড়ির সমস্ত লোকজন মামাবাড়িতে আসর জমাতো, সন্ধ্যেতেও অফিস ফেরত এসে উঠতো, আর রাত অব্দি গল্পগুজব করে একে একে বাড়ি ফিরত, বউ ছেলেপিলেরাও তাই। এক সন্ধ্যায় আমায় রেখে মা আর তাঁর ভাইবোনেরা মিলে নাইট শোতে সিনেমা যাবার প্ল্যান করছেন… আমি ভয়ানক ক্ষেপে আছি, দিদিভাই বছর দশেকের নাতনীর মন ভোলানোর জন্য কানে শাঁখ লাগিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনাচ্ছেন… ব্যস ! অমনি প্রথমে বুড়োখোকাদের মধ্যে সেই শাঁখ নিয়ে খানিকক্ষণ কাড়াকাড়ি চললো গর্জন শোনার, আর তারপরই সেই বিখ্যাত কথা – ‘কতদিন পুরী যাইনা! চল পুরী যাই!’

যাই তো যাই! তক্ষুনি জোগাড়যন্ত্র শুরু। টিকিট নিয়ে তাঁরা মোটে চিন্তা করতো না ; শৈশবে পিতৃহারা মায়েদের পিতৃসম স্নেহময় কাকা তখন রেলের কোনো উঁচু পদে কাজ করতেন, কি পদ বলতে পারবো না, সেকালে আপিস নিয়ে বোলচাল দেবার তেমন চল ছিলনা, তবে চাইলেই তিনি ঘোর সিজনেও যাচাই টিকিট জোগাড় করতে পারতেন। আর পুরীতে ঘরভাড়া জোগাড়ও কোনো কালে সমস্যা নয়। অনেক বাড়িওলার সঙ্গে যাত্রীদের আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে যেত তখন।

পরদিন সকাল অব্দি যাত্রী হল ষোল জন, দাদুভাই তবুও বলে গেলেন – আরও বাড়লে খবর দিতে ; ভুক্তভোগী কিনা ! সন্ধ্যেয় আঠারোটা টিকিট এলো, রাত দশটার মধ্যে আরো পাঁচজন যোগ হল, তারমধ্যে দিদিভাইয়ের বড়জা, আর তাঁর দুই বোন ; একজনের আবার সদ্য পা ভেঙেছে, এখনও ক্রেপ ব্যান্ডেজ আর লাঠি চলেছে। দাদুভাইয়ের মাথায় হাত – এখন উপায় ? অকুতোভয় সিনিয়র সিটিজেনরা বলে – ‘বিনা রিজার্ভেশনে যাব ! আমরা কি অবলা নাকি ?’

তবে কার্যক্ষেত্রে যেটা হল – আমার দুই মামা, তাঁদের দুই মামার সঙ্গে জেনারেল ডিব্বায় চড়ে বসলো, তাঁদের বার্থ দখল করলেন বীরাঙ্গনার দল।

রেলগাড়ি হৈ হৈ করে ছেড়ে দিল। বড় বড় টিফিন ক্যারিয়ার.. রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্র কি গোলাপ এনগ্রেভ করা লাল নীল বড় বড় ওয়াটার বোতল.. হোল্ডল, পাম্প বালিশ.. খুদে খুদে মিচকে কিছু ছেলেপুলে…অ্যানালগ- আগফা কি ইয়াসিকা ক্যামেরার বাক্স কাঁধে সতেরো আঠারোর তারুণ্য… সে এক রেলভ্রমণ ছিল বটে আমাদের শৈশবে ! ট্রেন ছাড়া মাত্র প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে নেওয়া… স্লিপার ক্লাসের জানলার ধারে সারা রাত জেগে দেখা- প্রকৃতির ছুটে যাওয়া… শেষ রাত থেকেই দিকচক্রবালে হাতির মত পাহাড়ের দল… বক ভর্তি গাছ… পুরী যে এসে গেল !

তখনও স্টেশনে নামা মাত্র ঝাঁকে ঝাঁকে আড়কাঠি এসে জোর জবরদস্তি নানা ট্যুর অপারেটরদের কার্ড গছাতে চাইতো, প্রায় সবারই নাম- এন এন মুখার্জি, সবাই নাকি আদি অকৃত্রিম ; পরম যত্নে কোনারক, চিল্কা, উদয়গিরি, খন্ডগিরি- সব দেখিয়ে শুনিয়ে দেবে। যাত্রী মাত্র জানতো ও কার্ড নিয়েছো কি মরেছো ! তবু প্রতিবার আমার ভালোমানুষ বাবা কারো না কারো কার্ড ঠিক নিয়ে নিতেন, আর পরে ঝামেলায় পড়তেন। এবারও যথারীতি শ্বশুরদের কড়া নজর এড়িয়ে জামাইয়ের হাতে এক আড়কাঠি কার্ড গুঁজে দিল।

স্বর্গদ্বারের কাছে একটি মন্দির আছে না, সিঁড়ির ধাপের পাশে – দুটো সিংহওলা ? সেই সিঁড়ি দিয়ে চব্বিশ জনের দল চললো লটবহর নিয়ে, চেনা বাড়ির উদ্দেশ্যে… হঠাৎ মহা শোরগোল ! এক ষাঁড় নাকি ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে তীব্র বেগে সেই সিঁড়ি দিয়ে নামছে… চারদিকে হুলুস্থুল ! দলের যে যে দোকানে পারলো উর্দ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়লো, পড়ে রইলেন শুধু ক্রেপ ব্যান্ডেজ আর লাঠি… শেষে পাশের সানগ্লাসের দোকানের হৃষ্টপুষ্ট মালিক তাঁকে কোলে তুলে দোকানে ঢুকিয়ে নিলেন। খানিক বাদে অলক্লিয়ার সিগনাল আসে লোকের মুখে, চব্বিশ জনের দল আবার রওনা হয় চেনা- ভাড়া বাড়ির দিকে…

সেখানেও বিপদ ! বাড়ি নাকি হাত বদল হয়ে গেছে, বাঙালি মালিক- ওড়িয়া মালিকের কাছে সম্পত্তি সমর্পণ করে বৃন্দাবন চলে গেছেন। সাত সকালে এতবড় দল দেখে নতুন মালিকের আক্কেল গুড়ুম – এত ঘর হবে না ! তিনতলায় খান তিনেক ঘর আছে, সেখানে চব্বিশ জন থাকলে তাঁর আপত্তি নেই। দীর্ঘদিন আসা যাওয়ার সুবাদে ও বাড়ির নাড়ি নক্ষত্র ট্যুরিস্ট পার্টির জানা, মায়ের মেজোমামা বলে- ‘একতলায় ওই তিনখানা তালা বন্ধ ঘর তো বড় পার্টি এলে খুলে দেওয়া হয়।’
– ‘ওগুলো ভিআইপিদের জন্য !’
– ‘ভিআইপিদের আপনার বাড়ি উঠতে বয়ে গেছে !’
– ‘এত বাজে বাড়ি তো এসেছেন কেন ? পুরী হোটেলে যান!’ বাড়ির অপমানে মালিক ভয়ানক ক্ষেপে ওঠেন।

অ্যাংরি ইয়াংম্যান মামাশ্বশুরকে সরিয়ে ঠান্ডা মাথার বাবা এগিয়ে যান সামাল দিতে- ‘আপনারাই তীর্থ দেবতা ! পুরনো খদ্দের আমরা, আপনি না বাঁচালে কে বাঁচাবে, আপনার বাড়ির সুনাম সারা ভারতবর্ষে’… ইত্যাদি ইত্যাদি। খানিক তোয়াজের পর মালিক নরম হন। তিনতলা আর একতলা মিলে ছটা ঘরের বন্দোবস্ত হয়। তবে এখুনি হবে না, আগে অফিসে বিরাজমান- জগন্নাথের সেবা হবে, তারপর ঘর পরিষ্কার হবে, তারপর ঘরের দখল পাওয়া যাবে। অগত্যা !

সে যা পুজোর ঘটাপটা বললে বিশ্বাস করবেন না ! মনে হল বেশ কয়েক ঘন্টার ধাক্কা। মায়ের জেঠিমা আসরে নামেন -‘আমার বাথরুমে না গেলেই নয়, বেজায় চাপ ! ঘর না খুলে দিলে জগন্নাথের সামনেই যা খুশি হয়ে যেতে পারে, ভেবে দেখ !’
আরো কজন সিনিয়র সিটিজেন তাল মেলান। বেয়ারা গিয়ে সুরসুর করে ঘর খুলে দেয়।

লেখক কেকা বসু দেব তার প্রথম উপন্যাস "উঠলো বাই, চোলো যায়" হাতে নিয়ে
লেখক কেকা বসু দেব তার প্রথম উপন্যাস “উঠলো বাই,চলো যাই” হাতে নিয়ে

গুছিয়ে বসেই দিদিভাই হুকুম দেন – এখুনি ছটা মগ চাই ! কেন ? না, দলের অন্তত ছ জনের জলে ফাঁড়া আছে। তাই তাঁরা সমুদ্রে চান করতে যাবে মগ নিয়ে ! আন্দোলন প্রচুর হল, কিন্তু মগ কেনাও হল। দিদিভাই প্রতিদিন- ফাঁড়া মাথায় মানুষগুলোকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিতেন- জলে না নামার। কিন্তু আড়ালে কেই বা কথা শোনে ? বোধহয় শ্রীক্ষেত্র বলেই ফাঁড়া বিশেষ ট্যা ফো করতে পারেনি, সবাই অক্ষত দেহে দ্যাশে ফিরেছিল।

এন্তার ঘুরে বেড়িয়ে, মাছ খেয়ে, রাত জেগে গল্প করে স্বপ্নের মত কেটেছিল দিনগুলি… যেমন কাটত সেকালে… শুধু একটাই ঝামেলা হয়েছিল- সেই এন এন মুখার্জির কার্ডটি নিয়ে। ওখানে নাকি নিয়ম- কার্ড নিয়েছো কি তুমি সেই এন এন মুখার্জির মুরগী। আমরা বিচে ঘুরে বেড়াই, আড়কাঠি পিছে পিছে চলে… দোকানে হাঁড়ি কেনা হয়, সেই আড়কাঠি ঠিক সিআইডির মত নজর রাখে। আমার ডাকাবুকো মা একদিন সরাসরি জানতে চান- ‘কেসটা কি ?’
– ‘আপনারা কবে সাইড সিনে ( sight seeing-কে কেন কে জানে ওই নামেই ডাকা হয়) যাবেন ?’
– ‘যে দিনই যাই তোমার কি ?’
– ‘আমাদের কার্ড নিয়েছেন, তাই আমাদের সঙ্গেই যেতে হবে।’
– ‘যাব না, কি করবে ?’
– ‘জলঅ কলঅ বন্ধঅ করি দিবঅ !’
– ‘আচ্ছা ! দেখাচ্ছি মজা ! কে কার জল কল বন্ধ করে !’ মা ফুঁসে ওঠেন- ‘মামী, এখনই বুল্টিকে ফোন কর, ওর আইপিএস বর এখন পুরীতেই পোস্টিং না ?’
বলাই বাহুল্য, বুল্টি বা তার স্বামীর বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিলনা!
দেশে যতই কুচুটেপনা করুক না কেন, বিদেশে বাঙালিরা ভাই ভাই ; তৎক্ষণাৎ আরো কজন ভালো মানুষ জুটে যান, ‘বৌদি, ফোন কেন ? পুলিশের বড় সাহেবের বাংলো তো কাছেই, চলুন আপনার বুল্টির বাড়ি একেবারে গিয়ে ওঠা যাক ! বুঝুক বাঙ্গালীর পেছনে লাগলে কি হয় !’
-‘হ্যাঁ ভাই চলুন !’

See Also
Com Kotha

আড়কাঠির মালিক এতক্ষন দোকান থেকে পুরো পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন, বেগতিক দেখে অকুস্থলে উপস্থিত হন ; তারপর মাফ টাফ চেয়ে একাকার কান্ড ! সেবার ওই এন এন মুখার্জির সঙ্গেই ভিডিও ওলা লাক্সারি টুরিস্ট কোচে ডিসকাউন্টেড রেটে আমরা যে রাজার হালে সাইট সিয়িং করেছিলুম তা দেখলে আপনারা নির্ঘাৎ হিংসে করতেন !

কে বলে- পুরী মানে শুধু জগন্নাথ আর সমুদ্র নিয়ে তৈরি এক টুরিস্ট স্পট ? পুরী আসলে আমাদের সবার আজন্মের শখ আহ্লাদের এক বিনি সুতোর মালা। যেখানকার প্রতিটি পথ, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি মন্দিরে যত্ন করে জমা আছে – তোমার আমার সবার হারানো কিছু সোনার দিন…

 

বইটি কিনতে এই লিঙ্কে যান

purushottam-bookstore.com/uthlo-bai-cholo-jai

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top