Now Reading
আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ১

আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ১

Avatar photo
football

কলকাতা আবেগপ্রবণ শহর। এই শহরে ফুটবল খেলা নিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। এইরকম কিছু ছোটবেলার অভিজ্ঞতা রাজকুমার মুখার্জির কলমে।

ভাগ – ১

ময়দানে এ কি কাণ্ড

মাঝে মাঝেই ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। বয়স বাড়লে যে বুড়োটে রোগ ধরে, এটা তাই। আমার তখন ক্লাস এইট, দাদা আসানসোলে মামার বাড়িতে থাকে (সেই দাদা মারা গেছে আজ আট বছর হয়ে গেল); তখন কলকাতা ময়দানে ফুটবল নিয়ে খুব মাতামাতি হত। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল। আমি ছিলাম মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক। ইস্কুলের গরমের ছুটি পড়লে আর মোহনবাগানের খেলা থাকলে মাঠে চলে যেতাম। সঙ্গে আরও তিনচার জন। পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে খেলা দেখবো, সে উপায় নেই। পয়সা মা দেবে না। সুবুজ গ্যালারির তিনদিক ঘেরা থাকলেও এক দিক শুধু কাঁটা তার দিয়ে বেড়া দেওয়া থাকত – রাম্পর্ট। তার পাশ দিয়ে চওড়া নালা চলে গেছে। নালার ওপারে দাঁড়িয়ে বা দুটো সাইকেল বেঁধে তার উপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হত। জানিনা এখনও সেই রকমই আছে কি না।

আমার একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেল নিয়ে মোহনবাগান মাঠে চলে যেতাম। তারপর কারো একজনের সাইকেলের সঙ্গে নিজের সাইকেল বেঁধে দুজনে সাইকেলের উপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম।

সেবার মোহনবাগান – খিদিরপুর খেলা। বেশ গন্ডগোল হচ্ছে। উলগানাথান মোহনবাগানের হয়ে গোল করেছে আর কেউ ঘোড়সওয়ার পুলিশের ঘোড়ার পায়ের কাছে পটকা ফাটিয়েছে – ঘোড়া সমেত পুলিশ নালার জলে। বাকি ঘোড়সওয়ার পুলিশ রে রে করে ঘোড়া ছুটিয়ে তেড়ে আসছে। লাঠি চার্জ। পুলিশ দর্শকের ইঁট ছোঁড়াছুঁড়ি। সাইকেলের বাঁধন খুলে পালাবার পথ পাই না। এরই মধ্যে অপুদা বলছে ওই দেখ কত উঁচুতে কে হাওয়াই চটি ছুঁড়েছে। আমার বন্ধু,ছটটু বলছে – ‘হাওয়াই চটি থেকে ধোঁয়া কেন’। আসলে ওটা ছিল teargas এর সেল। ছটটু কোনভাবে সাইকেল খুলে নিয়ে এলো, কেরিয়ারে ওকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচলাম।

যেদিন বাড়ি থেকে সাইকেল বার করতে পারতাম না ( মা তালা মেরে দিত), সেদিন বাড়ির সামনে থেকে ৭৬ নম্বর বাসের বাম্পার ভরসা ছিল। কন্ডাক্টর বাম্পার থেকে নামিয়ে দিলে, বাস ছাড়লেই দৌড়ে গিয়ে যে কোন একটা গেটে উঠে ঝুলতাম সবাই। প্রথম গেট থেকে নামিয়ে দিলে দ্বিতীয় গেটে – এভাবেই মাঠে চলে যেতাম। টিকিট কখনও করিনি, টিকেট কাটার কথা ভাবা মহা পাপ।কন্ডাক্টর গালিগালাজ করত, গায়ে মাখতাম না। কেউ কেউ আবার বলত – ‘পয়সা লাগবে না, উপরে উঠে আয়’।

বর্ষার জল-কাদায় মাঠ ময়দান করতাম। খেলা শেষ হলে, সাইকেল না থাকলে হয় বিনা টিকিট বাস অথবা হেঁটে বাড়ি আসতাম। ময়দান থেকে ভবানীপুর খুব একটা দূর নয়। এই রকম একদিন বাড়ি ফিরে বই নিয়ে পড়ার ভান করছি (কোন কালেই পড়তে ভালো লাগতো না), বাবা হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই মাকে বলছেন আমার মেরুন রঙের কোন জামা আছে কি না। মা সেদিনের ঘেমো মেরুন জামাটা বাবা কে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছেন এটা কি না। বাবা উত্তেজিত, হ্যাঁ এটাই তো। ও বাসে ঝুলতে ঝুলতে আসছিল। পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মা ভয় পেয়ে কেঁদেই ফেললেন। মা’ কে কাঁদতে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। ঠিক করেছিলাম আর মাঠে খেলা দেখতে যাবো না। কিন্তু কি করবো! তিনদিন বাদেই জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে খেলা – মাঠে না গেলেই নয় !!

আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো বাবুয়া, আমার বন্ধু। আমি তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্স। বাবুয়া এক ক্লাস উঁচুতে। একদুপুরে আমি আর বাবুয়া ডাক্তার ডাক্তার খেলছি। তার দিন চারেক আগে বাবুয়ার নালিশে আমি মায়ের কাছে বেদম ঠাঙানি খেয়েছি। আমি ডাক্তার, বাবুয়া রুগী। ইনজেকশনের নাম করে বাবুয়া কে দিলাম আলপিন ফুটিয়ে। যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলো – মার কাছে খবর গেলো। উত্তম মধ্যম। পিন ফোটানোর জায়গাটা কি বিশ্রী হয়ে পেকে গেছলো। অবশ্য আমার সারা গায়ে পিন ফোটানোর মত ব্যাথা বেশ কিছুদিন ছিল।

জীবনের উপান্তে এসে ছেলেবেলার টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো মনের গভীর অতল থেকে ভেসে উঠে। গপ্পো করতে বেশ লাগে।

See Also
খেয়ালের খেরো খাতা

আমার সেই সব বন্ধুরা কোথায় যে হারিয়ে গেল – জানি না। বাবুয়া কোথায় জানি না। বহু বছর কোন যোগাযোগ নেই।

এরকম আরো গল্প আছে ঝুলিতে, যদি চাও, বলতে পারি। ধৈর্য ধরে শুনতে হবে কিন্তু – অর্ধেক শুনলে চলবে না।

আবার দেখা হবে – গল্প করা যাবে।

What's Your Reaction?
Excited
4
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top