Now Reading
আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – ৮ (শেষ পর্ব)

আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – ৮ (শেষ পর্ব)

Avatar photo
Rajkumar reading book with the backgroud of books

ছোটবেলার মহা বিচ্ছু ছেলেটা কি করে যে বই প্রেমিক হয়ে গেল, সেই গোপন কথাটাই আজ জেনে নিই গতকালের বিচ্ছু, আজকের কাহিনীর লেখক রাজকুমার মুখার্জির কলম থেকে।

ভাগ – ৮ (শেষ পর্ব)

এতদিন ধরে পরপর কয়েকটি পর্বে আমার ছেলেবেলার গল্প বলছিলাম। যা পড়ে আপনাদের মনে হয়েছে শুধুই দুষ্টুমিতে ভরা ছেলেটা কি করে ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। আসুন আজ সেই দুষ্টুমির ফাঁক ফোঁকরের গল্প করি।

প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু জীবনের সবক্ষেত্রে হেরে যাওয়া একটা মানুষ। পড়াশুনা, জীবনের উন্নতি, আর্থিক – এই সবের গতি যে উসান বোল্ট্ এর গতির মত নয়, সেটা বলাই বাহুল্য।

এরই মধ্যে কেমন করে জানিনা, একটা একটা ক্লাস টপকে একদিন মাধ্যমিক পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে গেলাম। ডিসেম্বর মাসে টেস্ট পরীক্ষার ফল প্রকাশ হল এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম লিস্টের প্রথম দিকে আমার নামটা রয়ে গেল। ইস্কুল যাওয়া বন্ধ, বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সারাদিন থাকতে হত। সকালের দিকে সপ্তাহে তিনদিন বাজার করার ছাড়পত্র দেওয়া হত এবং তার সদ্ব্যবহার করে, বাজার থেকে পয়সা সরতাম। একতলায় কানাগলির রাস্তার ধারে একটা ঘরে দিনে ও রাতে দরজা – জানালা বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তাম। অনেকটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। ওই তিনমাস দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পড়তাম। পড়তে পড়তে বুঝতে পেরেছিলাম আসলে আমার কিছুই শেখা হয়নি। অতএব এখনই ঠিকমত না পড়লে, ফেল করতে হবে। ক্লাস সেভেনে একবার ফেল করে, ফেল করার কি জ্বালা জেনে গেছলাম।

সন্ধ্যেবেলায় একটা ফুচকাওয়ালা রোজ হাঁক পাড়তে পাড়তে পাড়া দিয়ে যেত। আমি তখন জানলা ফাঁক করে তার থেকে ফুচকা কিনে খেতাম। ২৫ পয়সায় চারটে। বাড়ির লোক একদিন বুঝে গেল। ফলে অন্য উপায় দেখতে হল। এখন ফুচকাওয়ালা গলিতে ঢুকে আর হাঁক পাড়ে না। আমার জানালায় এসে টোকা মারে, আমি জানলা খুলে ফুচকা খেয়ে পয়সা মিটিয়ে দেবার পর তার হাঁকডাক শুরু হয়।

ক্লাস টেনে পড়ার সময় একদিন আমার বান্ধবী, যারা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো, একই বছরে দুজনে মাধ্যমিক দিই এবং বর্তমানে যিনি আমার স্ত্রী, তাদের বাড়িতে “দেশ” পত্রিকাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা ধারাবাহিক “সেই সময়” একটি পর্ব পড়ি। পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। এটা প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। কালীপ্রসন্ন সিংহ, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, হরিশ মুখার্জি – অনেকের কথা, তত কালীন কলকাতার ভাষা, বর্ণনা। সেই আমার গল্পের বই পড়া শুরু নিজে থেকে। একে একে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত বাণী বসুর মৈত্রেয় জাতক; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রথম আলো; সমরেশ মজুমদারের কালবেলা, কালপুরুষ; সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর কাছের মানুষ; শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মানবজমিন পড়ে ফেললাম। শারদীয়া আনন্দমেলা তে প্রকাশিত মতি নন্দীর “স্টপার”, “স্ট্রাইকার”, “অপরাজিত আনন্দ” পড়া শেষ। ক্লাস টেন পাশ করে এগারো ক্লাসে এসে সমরেশ বসু, নীললোহিত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, আশাপূর্ণা দেবী প্রভৃতি লেখক লেখিকার লেখা পুরোদমে পড়তে শুরু করে দিয়েছি। ততদিনে ভবানীপুর পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য। বই নিজে পড়া এবং আমার বান্ধবী কে শুধু বই সাপ্লাই নয়, পড়া গল্প বা উপন্যাস গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা – পরবর্তী সময় সেটার উপর নির্ভর করে প্রেম। কলেজের বন্ধুদের থেকে হ্যারল্ড রবিনস, হ্যাডলি চেজ, অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, নিক কার্টারের লেখা রহস্য উপন্যাস পড়াও জোরকদমে চলছে। পড়ার বইয়ের মধ্যে গল্পের বই নিয়ে পড়তাম। এখনও মনে আছে চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কোপারফিল্ড পড়ে খুব কষ্ট হয়েছিল। আঙ্কেল টমস কেবিন পড়ে কেঁদেছিলাম। যেমন নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব পড়ে কেঁদেছিলাম। বুদ্ধদেব গুহর “খেলা যখন” পড়ে মনে হয়েছিল – এতো আমার কথা লেখা। এরই মাঝে নিষিদ্ধ উপন্যাস “রাত ভোর বৃষ্টি”, “লেডি চার্টারলিস লাভার” – এমনকি ফুটপাতে বিক্রি হওয়া হলুদ সেলফোন কাগজে মোড়া নিষিদ্ধ বইও দু একটা পড়ে ফেলেছি, সত্যি বলছি, ভালো লাগেনি।

এই ভাবেই বইয়ের সঙ্গে আমার সখ্যতা তৈরী হল। ধীরে ধীরে দুষ্টুমির পাল্লা হাল্কা হতে লাগলো। বইয়ের সঙ্গে ভালোলাগা গড়ে উঠা মানে এই নয় যে আমি রাতারাতি খুব ভালো ছেলে হয়ে গেলাম।

See Also

বারো ক্লাসের পর গ্র্যাজুয়েশন করতে এসে বদমাইশি অন্য রকম এবং সংখ্যায় কম হতে শুরু হল। না, সে বদমাইশি অন্য রকম, তার গল্প সকলের সামনে করা চলে না।

বইপড়া আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তখন বুঝতে পারিনি, আজ জীবনের উপান্তে এসে বুঝতে পারি। আজ চাকরী জীবন থেকে অবসর নেবার পরেও বই পড়ার অদম্য ইচ্ছেটা রয়ে গেছে। যারা আমার খুব কাছের মানুষ তাঁরা জানেন উপহার স্বরূপ বই, আমার কাছে অগ্রগণ্য। তাই তো আজও তাঁরা আমায় Amitav Ghosh এর Hungry Tide, Elif Shagak এর 10 Minutes 38 Seconds in a Strange World, Salman Rushdie র Midnight Children, জয় গোস্বামীর গোঁসাই বাগান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলন, Khaled Hosseine এর And the Mountains Echoed ইত্যাদি বই উপহার দেন। সত্যি বলতে কি, মনে হয় যদি বাকি জীবনটা বই পড়ে আর কিছু লেখালিখি করে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তবে বেশ হয়। আর্থিক নিরাপত্তা, সময়, সুস্বাস্থ্য এবং নিজের ইচ্ছে মত বেঁচে থাকাটাই তো অবসর। নয় কি?

এমনি করেই ছেলেবেলা থেকে একদিন বড়বেলায় পৌঁছে গেলাম।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
1
In Love
1
Not Sure
0
Silly
1
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top