আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৭
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ী ফিরতে দেরী। অজুহাত কি দিল রাজকুমার! আসুন দেখে নি এই গল্পে।
প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ
ভাগ – ৭
প্রাকটিক্যাল না টিউটোরিয়াল !!
আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, এগারো – বারো ক্লাস কি ইস্কুলের মধ্যে পড়ে? আমাদের সময় ওটা ইস্কুল এবং কলেজে পড়া যেত। যার যেমন ইচ্ছে। আমি মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হই নবাব মুর্শিদকুলি খানের আমলে – ১৯৭৯ সালে। প্রায় আড়াই লক্ষ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিল। তখন পাশ করত ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। দশ থেকে বার হাজার প্রথম ডিভিশন পেত। স্টার পেত খুব কম। আমি কোনদিনই তারকাদের দলে নই। না চিত্রতারকা না অন্য কোন তারকা। আসুন আজ গল্প করি ওই এগারো বার ক্লাসের।
মাধ্যমিক পাশ করার পর কমার্স পড়ব ঠিক করলাম। ইচ্ছে ছিল সাহিত্য পড়ব, বাবা বারণ করেছিলেন। সায়েন্স পড়া আমার কম্ম নয়। অঙ্ক – বিভীষিকা, আতঙ্ক। যে কটা কলেজ এবং স্কুলে কমার্সে ভর্তির দরখাস্ত করেছিলাম, সবকটিতেই নাম উঠলো। কেন নাম উঠেছিল, সেটা বলতে পারবো না। Goenka college of commerce, Co-education কলেজ, মা আপত্তি করলেন। অনেক ভাবনা চিন্তা করে বাড়ির কথা অগ্রাহ্য করে কলেজে ভর্তি হলাম। কারণ ১) অবাধ স্বাধীনতা পাওয়া যাবে ২) উচ্ছন্নে যাবার পথ প্রশস্থ ৩) আর যাই হোক স্কুলের বেদম মারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
কলকাতার হেরম্ব চন্দ্র কলেজ (সাউথ সিটি) এর বেঞ্চির শোভা বর্ধন করতে ঢুকে পড়লাম। বাড়ী থেকে 2B বা 47 নম্বর বাসে যাতায়াত। মা রোজ একটাকা দিতেন। কুড়ি কুড়ি চল্লিশ পয়সা বাস ভাড়া বাকিটা টিফিন। আমি প্রথমেই গরীব ছাত্র কনশেশনের কোটায় বাসের কার্ড করে নিলাম। যদিও বাবা ভালই চাকরী করতেন এবং ওই কোটায় কখনই এলিজিবল ছিলাম না। এলগিন রোড থেকে গড়িয়াহাট মাসিক ভাড়া চার টাকা সত্তর পয়সা। টাকার অঙ্কটা আজও বেশ মনে আছে। ওই কার্ডে যতবার ইচ্ছে বাসে চড়ে নাও। মাসে বাস ভাড়া থেকে ৭/৮ টাকা বাঁচাতে পারছি। এছাড়া বাড়ির বাজার থেকে মাসে ৮/১০ টাকা – সাকুল্যে মাসে ১৫/১৮ টাকা পকেটে। আমিই বা কে আর বর্ধমানের মহারাজাই বা কে! এছাড়া দৈনিক টিফিনের পয়সা তো হাতে আছেই – পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা থুড়ি দশ আনা। অতএব প্রথম কর্তব্য হল – আর ল্যাংটো চারু (চারমিনার সিগারেট) নয়, এবার NAVY CUT WILLS, যার প্রচলিত নাম ছিল Plain Wills. কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেতে গেলে আখেরে লস হয় তাই আবার বদলে চলে এলাম পুরানো ব্র্যান্ডে।
আমার দাদা এবং দিদি, দুজনেই সায়েন্স পড়ত। প্রাকটিক্যাল শব্দটার সঙ্গে বাড়িতে মা এবং জেঠিমার পরিচয় ছিল। যেদিন প্রাকটিক্যাল থাকতো, সেদিন দাদা বা দিদির আসতে দেরী হত। মা জানতেন, কমার্সে প্রাকটিক্যাল হয় না। তাই দেরী করে বাড়ী ফিরে ওই অজুহাত দেওয়া যাবে না। যা কিছু তাণ্ডব কলেজের সময় ১১টা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে করতে হত। কলেজ কেটে নুন শো তে চুটিয়ে সিনেমা দেখেছি। প্রিয়া, নবীনা, মেনকা সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। বিশেষত নবীনা সিনেমা হল ছিল সাউথ কলকাতার মেট্রো সিনেমা। খুব ভালো ভালো সিনেমা ওখানে দেখেছি।
হটাৎ একদিন বন্ধুরা মিলে ঠিক হল বিজলী সিনেমা হলে ম্যাটিনি শো তে “মেঘমুক্তি” সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে। দুপুর একটা অবধি কলেজ করে সিনেমা হলে দশ আনার লাইনে। আমরা প্রায় জনা পনের। আমাদের এক বন্ধু আগেরদিন নাইট শো তে ওই ছবিটাই দেখেছে। সে আসবে না, তাকে জোর করে ধরে এনেছি। তার নাম আজ আর বলা যাবে না, বর্তমানে সে পেশায় উকিল, ভালই পসার। যাই হোক, সে টিকিট না কেটেই ঝাঁকের মধ্যে ঢুকে গেল। তার কোন সিট নেই। এর তার কোলে বসে আছে। আমরা চিৎকার, ছেঁচামিচি করে বাকি লোকেদের উত্ত্যক্ত করছি। মাঝে মাঝে মুখের মধ্যে আঙ্গুল পুরে সিটি মারছি। লাইটম্যান বুঝতে পারছেন কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে, কিন্তু সেটা ঠিক কি, ধরতে পারছেন না। শেষমেশ এক এক করে টিকিট চেক শুরু হল।
সিনেমা শেষ, বাড়ী ফিরতে ছয়টা বেজে গেছে। মা সেদিন কোন এক কারণে বাড়ী ছিল না। বাড়ী ফিরতেই জেঠিমা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমায় বললেন “কিরে তোর আজ এত দেরী হল!” আমিও গম্ভীর হয়ে বললাম “প্রাকটিক্যাল ছিল”
— “আহা রে, মুখ শুকিয়ে গেছে, আয় বাবা খেয়ে নে।”
খেয়ে বই নিয়ে পড়তে বসেছি আর ভাবছি মা এসে জেঠিমা কে জিজ্ঞেস করলে তো জেঠিমা বলে দেবে আমার প্রাকটিক্যাল ছিল। উপায় –! যা হবে দেখা যাবে এই ভেবে বসে রইলাম পড়ার টেবিলে।
মা যথারীতি বাড়ি ফিরে জেঠিমা কে আমার ফেরার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি কান পেতে শুনছি। জেঠিমা বলছেন “খুকু, তুমি ওকে কিছু বলো না। বেচারীর আজ প্রাকটিক্যাল ছিল। মুখ শুকিয়ে বাড়ি এসেছে। খুব খিদে পেয়েছিল বেচারার।”
মা বললেন “প্রাকটিক্যাল! কমার্সের প্রাকটিক্যাল তো হয় না। দাঁড়ান দেখছি।”
মা জেঠিমা দুজনই আমার পড়ার টেবিলের সামনে হাজির। মার অগ্নিবান প্রশ্ন — “অ্যাই, তুই জেঠিমা কে বলেছিস তোর প্রাকটিক্যাল ছিল, তাই ফিরতে দেরী হয়েছে?”
যারা ছোট থেকেই বদমাইশ হয়, তাদের এরকম বিপদে, উপস্থিত বুদ্ধি চট করে মাথায় খেলে যায়। আমারও সেই মুহূর্তে বুদ্ধি খেলে গেল। জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বললাম — “কিগো, তোমাকে আমি কি বললাম? আমি বলেছি আমার টিউটোরিয়াল ছিল আর তুমি বলছো আমি তোমাকে প্রাকটিক্যাল ছিলো বলেছি।”
জেঠিমা হতভম্ব। আমতা আমতা করে বললেন “তাই বলেছে বোধহয়, আমি বুঝতে পারি নি”।
পলাশীর যুদ্ধে এবার সিরাজ, মানে আমার জয় হল।
কিন্তু জীবন যুদ্ধে….? আমার মা প্রায় চোদ্দ বছর হল গত, দাদা – দিদি – এরাও নেই। জেঠিমা আজও বেঁচে আছেন হয়তো বা এই বুড়ো ছেলেটার আরও কিছু দস্যিপনা দেখবেন – তাই।
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.