আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৬



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
এই গল্পে ছোটবেলার বিভিন্ন দুষ্টুমির কথা আপনাকে আপনার ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য। পড়ে দেখুন মজাও লাগবে এবং আবেগপ্রবণও হবেন।
লেখক : রাজকুমার মুখার্জি | প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ
ভাগ – ৬
বিদ্যে, বুদ্ধি – বলছি মশাই
আমার নিজের বুদ্ধি ও বিদ্যের উপর বিশ্বাস ছিল অগাধ। গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য – সব বিষয়ে আমি নিজেকে বিজ্ঞ তথা পণ্ডিত মনে করতাম। Self confidence চূড়ান্ত। যাদের অবস্থা নিদারুণ, লেখাপড়ার মান, মানদণ্ড ভেঙে দিয়েছে – স্বভাবতই তারা আমার প্রাণের বন্ধু, পরীক্ষার হলে আমার আশেপাশে বসতো, সেইসঙ্গে আমার খাতা দেখে লিখত বা আমার থেকে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত। ফল হত দারুণ। আমি যদি একশ তে কুড়ি পেয়ে ফেল করি, তারা কেউ দশ কেউ পনের পেয়ে ফেল করত। আমি ছিলাম ফেলুডেদের “রাজকুমার”।
শুধুমাত্র লেখাপড়ায় অমনোযোগী নয়, যে কোন রকমের খারাপ কাজের জন্য যদি ইস্কুল থেকে পুরস্কার দেওয়া হত, আমি হলফ করে বলতে পারি -সেই পুরস্কারের দাবীদার হতাম আমি। Best student of the year যদি পুরস্কার পায়, তবে Most Naughty student of the year কেন পুরস্কার পাবে না ?? স্পোর্টস এ Slow cycle race হয়। যিনি সব শেষে গন্তব্যে পৌঁছাবেন – তিনি প্রথম বলে বিবেচিত হবেন। কতকটা সেই রকম।
পুজোর ছুটির পর ইস্কুল খুলেছে। মহালয়া থেকে ভাইফোঁটা অবধি টানা ছুটি, সেই সঙ্গে বইপত্র সব তাকে উঠেছে। মহালয়া থেকে লক্ষ্মী পূজার পরদিন অবধি পড়তে নেই। তারপর বিজয়া করতে আসা আত্মীয় স্বজন; অবশেষে কালী পূজার আগের দিন থেকে বাজীর তদারকি শুরু করে ভাইফোঁটার দিনের ভুরিভোজ – পুরো ঠাসা ব্যস্ততা – দম ফেলার ফুসরত নেই – লেখাপড়া কোন ছার। বাবার স্থির বিশ্বাস ছিল ভবিষ্যতে আমায় রিক্সা চালাতে হবে। তবুও কি করে জানিনা আমি স্বাক্ষর হলাম এবং স্নাতকোত্তর অবধি লেখাপড়াটা হয়ে গেল।
যাক সে কথা, এবার আসি আসল গল্পে। পুজোর পর ইস্কুল খুলেছে। স্যর ক্লাসে এসেছেন। ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি। পায়ে চকচকে কালো নিউকাট পামশু। জুতো জোড়া খুলে টেবিলের পাদানিতে পাদুটি X এর মত করে রেখে বসেছেন; এবার পড়া শুরু হবে। আমাদের মধ্যে অতি উৎসাহী একজন টেবিলের কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। ব্যাস শিয়ালকে বেড়ার ফাঁক দেখানোর মত। সবাই মিলে গিয়ে প্রণাম শুরু করে দিলে। স্যর বিগলিত। “আহা থাক, থাক” বলছেন। প্রণামের হুড়োহুড়ির সুবর্ন সুযোগ নিয়ে দিলাম পায়ে চিমটি কেটে। স্যর সটান উঠে দাঁড়িয়ে, টেবিলের উপর দিয়ে সামনে ঝুঁকে, যে কটা পিঠকে নিচু হয়ে প্রণাম করতে দেখতে পেলেন – দুহাতে দমাদ্দম কিলোতে লাগলেন। আমি ততক্ষনে নিজের বেঞ্চে ভালো ছেলের মুখটি করে বসে।
ক্লাস সেভেন। ইংরেজি গ্রামার পড়ানো হত রেন অ্যান্ড মার্টিনের লাল মলাটের বই। কি শক্ত – বই এবং বইয়ের বিষয়বস্তু। দিলীপ বাবু পড়াচ্ছেন। পিছনের বেঞ্চে বসে বার দুয়েক বাঘের ডাক ডেকেছি। স্যর ঠিক ঠাওর করতে পারছেন না। স্যর পড়া ধরছেন comparative/superlatives. স্যর একটা শব্দ বলছেন – তার দুটি form বলতে হচ্ছে। স্যর বলছেন Dear – উত্তরে বলতে হচ্ছে dearer, dearest. আমাকে বললেন ‘স্ট্যান্ড আপ’। আমি বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম। স্যর বললেন GOOD। আমি ভাবলাম টান টান হয়ে দাঁড়িয়েছি তাই good বললেন। আমি মুচকি হাসলাম। স্যর বললেন -” কি রে বল!” আমি বললাম “কি স্যর?” উনি বললেন “GOOD এর দুটো form বল”। চটজলদি উত্তর দিলাম “Good-Gooder-Goodest”. ভাগ্যিস আমার জন্মের বারবছর আগেই জর্জ বার্নার্ড শ এর মৃত্যু হয়েছিল, নচেৎ আমার এহেন উত্তরে নাট্যকারের হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে যেত।
পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির রোল উঠলো। যারা জানত তারা কারণে হাসলো, কেউ কেউ না জেনে জানার ভান করে হাসলো — আমিও হাসলাম। জেনে বা না জেনে নয়। বাকি সবাই হাসছে দেখে। নয়তো লোকে বোকা বলবে।
সে বছর অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফল বের হল। আমি Class VII Not Promoted.
আমার পিতৃদেব বুঝেছিলেন ওনার এই অপগণ্ড পূত্রটিকে ঠিক করতে গেলে তাঁকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে, মাস্টার দিয়ে পুরোটা হবে না। দুষ্টু ঘোড়াকে লাগাম পরাতে যে রকম বেগ পেতে হয়, সেই রকম বেগ সামলাতে হয়েছিল। বহুচেষ্টার পর বাড়িতে নিয়মিত The Statesman কাগজ আসতে লাগলো। প্রতি রবিবার, দুপুরের খাওয়ার পর, পিতৃদেব অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেই কাগজ পড়াতেন। শব্দের অর্থ না বুঝতে পারলে, অভিধান দেখতে বলতেন। বিড়ম্বনার একশেষ। একটি একটি শব্দ ধরে অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে গল্পের মত করে বুঝিয়ে দিতেন। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট মজার গল্প বলতেন। তারপর কোথা দিয়ে যে ‘I go your with’ একদিন ‘I shall go with you’ হয়ে গেল – জানি না।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.