আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৫



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন প্রকারের ভয় আমাদের জীবনে থাকে ।এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা রাজকুমার মুখার্জির কলমে।
প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ
ভাগ – ৫
ভয় ভাবনা
একটা আস্ত জীবন কেটে যেতে বসেছে। এই জীবনে যেটা উপলব্ধি করলাম সেটা হল – আমার মত আটপৌরে সাদামাটা নিম্নবিত্ত মানুষের সারাটা জীবন স্থবিরের মত জুড়ে থাকে তিনটে বস্তু উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা ও ভয়। না ঠিক বস্তু বললে ব্যাকরণ গত ভুল বলা হবে – উপলব্ধি। এই উপলব্ধি গুলো হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে কত ধানে কত চাল।
যখন ছোট ছিলাম, মাত্রা ছাড়ানো বদমাইশি করলে মা বলতেন “আজ বাবা বাড়ি আসুক, সব বলে দেবো “। বাবাকে ভয় করতে শেখানো। যদিও বাবা কখনও বকতেন না। মা’র কোনদিন বাবার কাছে খাই নি। ওসব বকাঝকা, পিটানি – ওগুলো মায়ের জিম্মায় থাকত। কাঠের স্কেল, হাঙ্গার, পুরীর লাঠি – কত নাম বলব, সবার টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদ এই পিঠ যে পরোখ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে যাক গে যাক। হ্যাঁ, ভয়ের বীজ বপন শুরু তখন থেকেই।
খুব ছোট বয়সে – দশ কি এগারো, বাংলাদেশের একটা সিগারেট আমাদের এখানে পাওয়া যেত। মুক্তি, দাম ছিল তিন পয়সা। মুক্তির আশায় এক বন্ধুর সাথে ভাঙা মাঠে “মুক্তি” তে টান মেরেছিলাম। মুখে সিগারেটের গন্ধ। বাড়িতে ধরা পড়ে যাবো, কপালে মার ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। এই ভয়ে সাবান গুলে কুলকুচি করছি, মা ধরে ফেললেন — নিশ্চয় কোন খারাপ কাজ করেছি। ধোলাই।
গঙ্গা যমুনা মিষ্টির দোকান থেকে ১৫ পয়সার দই কিনতে বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। মাটির ভাঁড়ে দই, উপরে পাতলা কাগজ চাপা। লোভ সামলানো দায়। কাগজে চাপ দিচ্ছি আর তুলে নিচ্ছি। দই কাগজের সঙ্গে উঠে আসছে। প্রাণভরে সেই দই চেটে নিচ্ছি। কাগজ গেল ছিঁড়ে। বাড়িতে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে কাগজটা ছেঁড়া দিয়েছিল। আবার মার।
এরপর ইস্কুল। প্রতি শনিবার জ্যামিতি। অঙ্কের স্যার, চিত্তবাবু, দারুণ সাংঘাতিক। পড়া না পারলে বেদম মার। কখনও কাঠের কম্পাস দিয়ে, কখনও স্কেল দিয়ে, কখনও চড় চাপটা। আমার বিদ্যের বহরে উপপাদ্য, সম্পাদ্য এদের যে কি নিদারুণ অবস্থা হত বলার নয়। আমি যে ইস্কুলে পড়তাম, সেই ইস্কুলে অঙ্ক করাতেন শ্রদ্ধেয় কেশব চন্দ্র নাগ মহাশয়। ভাগ্যিস আমার ছাত্রাবস্থায় তিনি ছিলেন না, তার আগেই অবসর নিয়ে ছিলেন, নাহলে ওনার দুঃখের অন্ত থাকত না। পিথাগোরাস, আর্কিদিমিস – এনাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিত্য নতুন পদ্ধতিতে অঙ্ক কষে বোর্ডে স্যর কে দেখাতাম। না গণিতজ্ঞ হই নি, উল্টে বেদম প্রহার। আবার একটা ভয় – প্রহারের ভয়। সারা স্কুল জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। শুধু অঙ্ক কেন, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত – এমনকি হস্তশিল্প সেখানেও আমার বিড়ম্বনার শেষ নেই। অঙ্ক পরীক্ষার দিন হল থেকে বেরিয়ে ভালো ছেলেদের থেকে অঙ্কের উত্তর প্রশ্নপত্রের উপর লিখে নিতাম। বাড়ির মাষ্টারমশাই অঙ্কের উত্তর জানতে চাইবেন তারপর নিজে অঙ্ক কষে উত্তর মিলিয়ে দেখবেন। ভুল হলে ধোলাই। আরে বাবা রেজাল্ট বের হলে তো কপালে এক প্রস্থ পিটানি আছে, একই কাজের জন্য দুবার মার কেন খাবো। এখানেও ভয়, আশঙ্কা। ঠিক উত্তর লিখলাম তো!
স্কুল জীবন কোনমতে উৎরে গেল। এলাম কলেজে। সাপের পাঁচ পা দেখার দিন শুরু। নাকের নীচে পাতলা গোঁফ। সরস্বতী পুজো আর অষ্টমীর সকালে এলো চুলের কত কাব্য। কারো জন্য আবার বুকের মধ্যে গির্জার ঘন্টা বাজার আওয়াজ। এক বুক হা হুতাশ। যাদবপুর, শিবপুর, দুর্গাপুর, মেডিক্যাল কলেজ, আর জী কর আমার মত ফেলুড়ের থেকে একশ যোজন আগে। একটা চাকরি চাই, ঝা চকচকে অফিস হবে, নিজের মোটর বাইক হবে, স্বপ্নের পরীকে পিছনে বসিয়ে পক্ষিরাজ ছুটিয়ে যাদবপুর, শিবপুর, মেডিক্যালের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। উৎকণ্ঠা গ্রাস করতে লাগল যদি হেরে যাই – আশঙ্কা। সব মিলিয়ে জন্ম নিল ভয়।
নাহ্, অকুতভয় হাওয়া গেল না ।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.