আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৪



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
পকেট মানি বাঁচিয়ে অনেকেই সিনেমা দেখতে যায় কিন্তু এত পুরো চুরি ? আরো একটা মজার গল্প রাজকুমার মুখার্জির কলমে
প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ
ভাগ – ৪
আমি ও হলিউড সিনেমা
খুব ছোট বয়স থেকে আমি বাজার করি। আমার বয়স তখন ১৪/১৫ ক্লাস নাইন। এখনকার মত তখন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না। ফ্রিজ থাকলেও রান্না করা খাবার, ফ্রিজে রেখে খাওয়া হত না। মা কে দেখতাম অনেক ভোরে উঠে কয়লার উনুনে আঁচ দিতে। বর্ষার দিনে ভেজা কয়লা নিয়ে নাস্তানাবুদ হতে দেখেছি। বাবা ঠিক নটার সময় অফিস যেতেন, তারই মধ্যে বাবার অফিসের ভাত, টিফিন সব তৈরী হয়ে যেত। কি অসম্ভব ক্ষমতা ছিল।
এখনও বেশ মনে আছে আমাদের বাড়িতে একদিন অন্তর একদিন বাজার হত। বাজারের ভার ছিল আমার উপর। ৭ টাকা ৫০ পয়সা বরাদ্দ। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা ১৯৭৭ সাল, প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। তখন ৭ টাকার দাম অনেক। মাছ কিনতে চার টাকা, বাকি টাকায় সবজি। ওই বাজারের টাকা থেকে পয়সা সরাতাম – ইয়ে চুরি করতাম — কিরকম! যদুবাবুর বাজারের পাশেই মোহিনী মোহন রোডে ছিল ঘড়ার মিষ্টির দোকান। শাল পাতার ঠোঙায় দুটো কচুরি একটা জিলিপি – ২৫ পয়সা। এরপরও কমবেশি আরও ২৫ পয়সা। সাকুল্যে ৫০ পয়সা বা আট আনা প্রায় দিন সরাতাম।
এবার হিসাব মেলানোর পালা। জিনিসের দাম বাড়িয়ে বললে ধরা পড়ে যাব। তখন জিনিসের দাম রোজ উঠা নামা করত না। ওজনে চুরি করতাম। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। বাড়ি থেকে ছোট মাছ আনতে বলেছে। ট্যাংরা, চারাপোনা – এই সব মাছ হাল্কা। ৫০০ গ্রামের বদলে ৪৫০ গ্রাম নিলে, গুন্তিতে অনেক, ওজনে কম। তখন ওই সব মাছের দাম ছিল ৭/৮ টাকা কেজি। ৩৫ থেকে ৪০ পয়সা বেঁচে গেল। অঙ্কে আমি পরীক্ষায় অনেক বড় শূন্য পেলেও এই অঙ্কে আমি দড়।
যা বলছিলাম চার আনার কচুরি জিলিপি হল, বাকি চার আনা থাকতো স্কুলের ব্যাগে, সবার চোখের আড়ালে, লুকিয়ে। ওটা জমত। ওটা দিয়ে কি হত? বলছি, একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আসল লোকটার নাগাল পেতে গেলে একটু সময় দিতে হবে বৈ কি!
আমি পড়তাম ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে। হরিশ পার্কের পাশেই পুরানো এবং আদি স্কুল বাড়ি। নতুন স্কুল বাড়িটা ছিল পার্কের পিছনে। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর মর্নিং, ফাইভ থেকে এইট পুরানো বাড়ি সকাল এগারোটা থেকে, নাইন ও টেন নতুন বাড়ি সকাল এগারোটা থেকে।
ইস্কুল থেকে প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ছিল পূর্ন সিনেমা হল। নুনশো শুরু হত দুপুর বারোটা থেকে। দারুণ সব ইংরেজি ছবি দেখানো হত। টেন কমান্ডমেন্টস, গানাস অব নেভারনস, ম্যাকিনাস গোল্ড, মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, জ্যাঙ্গো, রেড সান ইত্যাদি।
স্কুলের বেঞ্চি ভাড়া, যাকে টিউটিশন ফি বলে, নেওয়া হত স্কুলে, ব্যাংকে জমা করার রীতি তখনও চালু হয় নি।পুরনো বাড়িতে সোম, বুধ, শুক্র এবং নতুন বাড়িতে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি – ঠিক দিনগুলো মনে পড়ছে না। তবে তিনদিন করে ভাগ করা থাকতো। নতুন স্কুল বাড়ির পড়ুয়াদের টিফিনে স্কুলের বাইরে যেতে দিত, স্বাধীনতা দেওয়া – ইচ্ছে করলে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতে পারবে। টিফিন ছিল আধ ঘণ্টা। ১.৪০ থেকে ২.১০ অবধি।
বাকি চার আনার হিসাব দিতে “ধান ভানতে শিবের গীত” কেন – এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। সবার সঙ্গে সবার যোগসূত্র আছে। পেয়াঁজ ছাড়ানোর মত।
ছটা বাজার করলে, কচুরী জিলিপি খেয়েও ১ টাকা ৫০ পয়সা বাঁচানো যেত। নুনশো টিকিটের দাম ১ টাকা ৪০ পয়সা। কোন একদিন টিফিনে বেরিয়ে অ্যাডভান্স টিকিট কেটে রাখতাম সেই দিনের, যে দিন কেবলমাত্র পুরানো বাড়িতে ফি জমা নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পিরিয়ড ১১.৪০ শুরু হল। স্যর কে ফি বুক দেখিয়ে ফি জমা দেবার নাম করে পুরানো বাড়িতে যাবার অনুমতি নিয়ে স্কুলের বাইরে রাস্তায়। সোজা সিনেমা হল। ব্যাগ রইল ক্লাসে। টিফিন অবধি কোন স্যর জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবে পুরানো বাড়িতে মাইনে দিতে গেছে। সন্দেহের উর্দ্ধে।
আমি তখন ইংরেজি সিনেমার ছবি দেখছি। ডায়ালগের বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারছি না; শুধু action দেখে পুরো গল্পটা অনুধাবন করতে পারছি। নিজেকে তখন ইংরেজি সিনেমার নায়ক মনে হত। কখনও ক্লার্ক ডগলাসের মত কাওবয়, গ্রেগরি পেগের মত ছটা বেজে পাঁচের মতন ঘাড় বেঁকিয়ে হাঁটতে; ফ্রাঙ্কো নিরোর মতন ফেলট হ্যাট পরে, ঠাণ্ডা কঠিন চাউনিতে সব ধ্বংস করে দিতে; ইউল ব্রেন্যের মতন সুঠাম শরীরের অধিকারী হতে অথবা লাস্যময়ী আদ্রেও হেপবার্ন এর মত কোন বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করত। সে যাই হোক, সিনেমা শেষ হত দুটো বেজে দশ মিনিটে। একছুট – স্কুলে। টিফিন শেষে স্কুলের গেট বন্ধ হব হব করছে, ঢুকে পড়লাম। যেদিন দেরী হয়ে যেত, রেডিমেড মিথ্যে বলে দিতাম – যেটা তখন প্রয়োজন। পুরোটা পার্মুটেশন কম্বিনেশনের অঙ্ক কষার মতন।
এই রকম করে গোটা পাঁচেক সিনেমা দেখে ফেলেছি। কোন এক কারনে কার্তিক বাবু, জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন, যার লেখা বই খুব প্রচলিত, আমায় স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় সিনেমা ভাঙার সময় ধরে ফেললেন। চালান হলাম হেড স্যারের ঘরে। আমি যে কি রকম পদের, সবাই জানতেন। কাপড় কাচা হয় যে রকম আছাড় মেরে, পারলে সেই রকম আছাড় মেরে আমার ধোলাই হল – না, গার্জেন কল হয় নি।
এর পরেও আমি বহুদিন অবধি বাজার করেছি এবং পয়সা সরিয়েছি। পরবর্তী সময়ে বাজারের বরাদ্দ ৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়তে লাগলো সেই সঙ্গে আমার পয়সা সরানো Arithmetic Progression এর সূত্র ধরে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.
Great going friend !! Reliving my childhood through your pen ……