Now Reading
আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৩

আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা – পর্ব ৩

Avatar photo
The beautiful Girl asking the boy what is the time for pushpanjali

সরস্বতী পুজো বাঙালিদের ভ্যালেন্টাইন ডে । ছেলেবেলার ঐ দিনের বিস্তারিত বিবরণ রাজকুমার মুখার্জির কলমে।

প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ

ভাগ – ৩

সরস্বতীর আগমনে আমরা সবাই

হটাৎ রাস্তায় বহুদিন বাদে কলেজের বা ইস্কুলের বন্ধুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় — দেখা হবার পর, একে অপরকে চিনতে পারছি অথচ নাম মনে করতে পারছি না — এই রকম অবস্থা হয়, তখন কিরকম লাগে বলুন তো!! ছেঁড়া ছেঁড়া সেইরকম স্মৃতি নিয়েই আমাদের ছেলেবেলা, আমাদের কৈশোর। নাকের নীচে সদ্য সোনালী গোঁফের রেখা, গলা ভেঙ্গে গম্ভীর গলা, বয়সন্ধি কাল। আসুন সেই সময়ের গল্প করি। তখন ছিল ঘটনা, পঞ্চাশ বছর বাদে সেগুলো এখন গপ্প।

আমার তখন ক্লাস নাইন। আমাদের খুব সুখের ও মজার স্মৃতি — সরস্বতী পুজো। প্রথমে বলি ইস্কুলের পুজোর কথা। আমাদের ছিল বাংলা মিডিয়াম ইস্কুল। সরস্বতী পুজো হত বেশ বড় করে। নিয়ম ছিল ক্লাস নাইন পুজো করবে। ক্লাস টেন মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত। ক্লাস নাইন পুজোয় অগ্রণী ভূমিকা নেবে।

প্রথম পিরিয়ড শেষ হলেই দশ বার জন চাঁদা তুলতে বের হতাম। সব ক্লাস ঘুরে ঘুরে বিল কেটে চাঁদা তুলতে হত। চাঁদা ছিল এক বা দুই টাকা। যদি ভাই পড়ে, তবে একটা চাঁদা হলেই চলত। দিন দশেক ধরে রোজ দলে দলে ভাগ হয়ে চাঁদা তোলার পর্ব ছিল। বিল দেখিয়ে পুজোর দিন ভোগ খাওয়ানো হত। একেবারে বসিয়ে খাওয়া। খিচুড়ি, ল্যাবরা, চাটনি, পায়েস এবং শেষ পাতে একটা রসগোল্লা। সকাল এগারোটা থেকে চলত খাওয়ানোর পর্ব। ইস্কুলের কোন একজন স্যর পুজো করতেন। নামটা মনে পড়ছে না।

পুজোর দুদিন আগে আশপাশের ইস্কুলে গিয়ে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রন করতে হত। বেশী উৎসাহ ছিল মেয়েদের ইস্কুলে যাওয়া নিয়ে। আমাদের ইস্কুলের আশেপাশে গোটা তিনেক মেয়েদের ইস্কুল ছিল। বেশ মনে আছে আমরা ছয়জন মিলে পালা করে মেয়েদের ইস্কুলে নিমন্ত্রন করতে গিয়েছিলাম। আমি আর আমার এক বন্ধু গেছলাম ভবানীপুর গার্লস স্কুলে। বাইরে সবাই অপেক্ষারত। ইয়া গোঁফওয়ালা দারোয়ান আমাদের সবাইকে ঢুকতে দেবে না, কেবল মাত্র একজন যেতে পারি। আমরাও নাছোড়বান্দা। কমপক্ষে দুজনকে যেতে দিতে হবে। অবশেষে দারওয়ানজি রাজী হলেন। আমি আর আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু (যার নামটা আজ কিছুতেই মনে পড়ছে না) ঢুকলাম। আশা ছিল অনেক মেয়েরা থাকবে, আমরা তাদের মাঝ দিয়ে গট গট করে চলে যাবো। সেগুড়েবালি। এক — তখন ক্লাস চলছে, সুতরাং ” তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই”। দুই — ইস্কুলের উঠান পেরোলেই বড় দিদিমণির ঘর। মধ্য বয়স, আমাদের মায়ের মতন, চোখে চশমা। কি বাজখাঁই গলা। পিলে চমকে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

— কি চাই, কোথা থেকে এসছো?

ওরে বাবা, গলা তো নয় যেন কামান। ভয়ে প্যান্ট ভিজে যায় আর কি! স্টাইলের বেলুন ফুস।
কিছুটা তুতলে, কিছুটা হোঁচট খেয়ে আসার কারণ বললাম, কার্ডটা টেবিলে রেখে দে দৌড়। বাইরে এসে ভারিক্কি চালে বন্ধুদের গুল মারলাম।

— “বড়দির ঘরে যাবার রাস্তায় একটা মেয়ে, বেশ সুন্দর দেখতে, আমাদের ঝাড়ি মারছিল।”
সবাই ঘিরে ধরল, ” তারপর, তারপর”??…….

পুজোর আগের দিন পোটো পাড়া থেকে ঠাকুর আনা, পুজোর ঘর সাজানো, আলপনা দেওয়া, exhibition ঘর সাজানো, হরেক কাজে ব্যস্ত। পুজোর দিন নিচু ক্লাসের বাচ্চাদের বেঞ্চিতে বসিয়ে খিচুড়ি পরিবেশন করে খাওয়ানো, সন্ধ্যে বেলায় স্কুলের উঠানে গোল হয়ে বসে আড্ডা মারা — কত লোকের আনাগোনা — এসব দেখতে দেখতে পার হেয়ে গেল। পুজোর দিনটা ঝড়ের মত কেটে যেত। সব স্যর হেসে হেসে কথা বলতেন। আমার মতন হাড় বজ্জাত ছেলেও সেদিন good boy হয়ে যেত। ওই একবছর ছিল ইস্কুলের পুজোর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।

মজা ছিল বেশি পাড়ার পুজোয়। Boys Sporting Club — এটাই ছিল আমাদের সরস্বতী পুজোর ক্লাব। একমাস আগে থেকে প্রস্তুতি চলত। তারও বহু আগে থেকে চলত আমাদের জোগাড়। পাড়ায় কারো বাড়িতে প্যান্ডেল বেঁধে অনুষ্ঠান হলে আমরা ডেকরেটর এর বাঁশ, কাপড়, দড়ি ইত্যাদি ঝেড়ে রাখতাম। মিশন সরস্বতী পুজো। চাঁদা তুলতে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম। প্রায় সবাই চাঁদা দিতেন — এক বা দু টাকা। অনেকে চাঁদা দিতেন না আবার তাড়িয়ে দিতেন। ফেরার সময় তাদের বাড়ির বাইরের বাল্ব খুলে নিতাম বা ভেঙে দিতাম। এনিয়ে বহু নালিশ বাড়িতে এসেছে, মায়ের কাছে মার, বকা — ওসব জল ভাত।

পুজোর আগের দিন শুরু হত প্যান্ডেল বাঁধা, নিজেরাই বাঁশ, কাপড় দিয়ে প্যান্ডেল বাঁধতাম। সঙ্গে থাকত একটা রাত জাগার ঘর — আসলে ওটা ছিল রাতে বিড়ি ফোঁকার আস্তানা। পুজোর রাতে টিভি ভিসিআর ভাড়া করে সিনেমা দেখার ফাঁকে ওই আস্তানায় গিয়ে চলত বিড়ি ফোঁকা। যা বলছিলাম, সারারাত ধরে চলত প্যান্ডেল বাঁধা। এরই মাঝে একদল গিয়ে যদু বাবুর বাজার থেকে বাজার করে আনত। সেই সঙ্গে ছিল ফলের দোকানে হাত সাফাই। কলাটা, লেবুটা যে এ হাত ও হাত ঘুরে আসতো না, সেটা অস্বীকার করি কি করে! মধ্য রাতে হানা দিতাম অন্যের বাড়িতে, ফুলের টব, ফুল, গুদামের ইঁট — মন্ডব সাজাতে, বেদি বানাতে এসব দরকার। যার টব তুলে এনেছি, তিনি হয়তো পরদিন বাজার যাবার সময় বলে গেলেন ” এই পুজো হয়ে গেলে, টব বাড়িতে পৌঁছে দিবি, দেখিস ভাঙিস না।”

See Also
Mihir Kar Purkayastha

সেবার আমি ক্লাস টেন। আমাদের পাড়ায় এক ফ্যামিলি এসেছেন। তাদের মেয়ে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ে, ডাক সাইটে সুন্দরী, ফট ফট করে ইংরেজি বলে, আমি বাংলা ইস্কুল, তাই শুনে হাঁটু দুটো ঠক ঠক করে কেঁপে উঠে। যদি ইংরেজি বলতে হয়, ওই ভয়ে অনেক দূরে দূরে থাকতাম। পুজোর দিন, স্নান সেরে লাল পাড় বাসন্তী রঙের শাড়ি, বব কাট চুল, আমাকে এসে বললে —
“এই শোনো, তোমাদের অঞ্জলী কখন হবে? আমায় একটু ডেকে নেবে?”

সপ্ত সুরে বীণা বেজে উঠলো আমার মনে, গলা শুকিয়ে কাঠ। একটি শব্দও মুখ ফুটে বের হল না। শুধু মাথা নাড়লাম। এরকম গুরু দায়িত্ব বোধহয় পিতামহ ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও পান নি। পুরুত মশাই আসার পর থেকে কতবার যে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি ‘ অঞ্জলী কখন হবে ‘ তার ঠিক নেই। সেই সরস্বতী পুজোর দিনটা আমার রাজ হাঁসের ডানায় ভর করে কেটে গেল।

তারপর তারা পাড়া ছেড়ে চলে গেল। বহুবছর বাদে তাকে একবারই দেখেছিলাম পার্ক স্ট্রিটে, মিনি বাসের জানালা দিয়ে, ঝকঝকে স্মার্ট এক তরুণের হাত ধরে, একমুখ উচ্ছাস ছড়িয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। আমি তখন সওদাগরী অফিসের নটা ছয়টার কেরানী।

সরস্বতী পুজো ছিল আমাদের ভ্যালেন্টাইন ডে।

What's Your Reaction?
Excited
4
Happy
2
In Love
1
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top