Now Reading
আমার রোজনামচা

আমার রোজনামচা

Avatar photo
old couple having a morning walk while a little girl is going to the school holding her Mom's hand

এই গল্পে লেখক নিজের রোজনামচার বর্ণনা করছেন। জীবনের ছোট ছোট সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। প্রাতঃ ভ্রমনের সময় শিশু দের দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার একটা অংশ এই শিশুদের মধ্যে।

লেখক : রাজ কুমার মুখার্জি

একটা কর্মজীবন শেষ হয়েও হচ্ছে না। আমার বয়স যখন ২১ তখন থেকে কর্মজীবন শুরু। একবছর হতে চলল চাকরী জীবন থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু কাজ এখনও করি। পেটের দায়, বড় দায়, তাই কাজ করা। এখন জীবন, আর আগের জীবন, অনেক তফাৎ। এখন ব্যস্ততা, দায়বদ্ধতা আগের চাইতে কম। একটা বিস্তর ফারাক।

রোজ ভোরে হাঁটতে বের হই, আমি আর আমার  সহধর্মিনী। মিঠুর পায়ের ব্যথার জন্য জোরে হাঁটতে পারে না। থেমে থেমে হাঁটতে থাকে। দুজনেই বুড়ো বুড়ি। রোজ সকালে দেখি উজ্জ্বল একঝাঁক সদ্য ফোটা ফুলের মত ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা ইস্কুল চলেছে। আমি সবার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করি। কাউকে একটু মুচকি হেসে, কাউকে ভ্রু তুলে কুশল বিনিময় করে, কাউকে বুড়ো আঙ্গুল তুলে শুভেচ্ছা জানিয়ে। বিশেষ কেউ পরিচিত হলে দু একটা বাক্য বিনিময় হয় বইকি। আমার কাছে ভোরের ছোট্ট সময়টা দিনের সবচাইতে সুন্দর সময়। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নই – কিন্তু কেন জানি মনে হয় ঈশ্বর বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার একটা অংশ নিশ্চয় এই শিশুদের মধ্যে আছে, লুকিয়ে।

এইতো সেদিন বৃষ্টি দিদির সঙ্গে দেখা। ইস্কুল চলেছে মায়ের হাত ধরে। স্কুলের পোষাক, গলায় পরিচয় পত্র ঝুলিয়ে – বেশ লাগছে।আমায় দেখে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে গেল। আমি বললাম – আরে বৃষ্টিদিদি তুমি একা! পুকুদিদি কই? বৃষ্টি বলল – পুকু দিদি ক্লাস ফাইভ আমি তো prep II আমাদের সময় তো আলাদা হবে। আমি বললাম তোমার কার্ডটি বুক পকেটে ঢুকে গেছে, বার করে নাও। বৃষ্টি দিদি কোমরে হাত দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে আমায় বললে – তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না। এখন এমনি করেই নেয়, এটা স্টাইল । সত্যি আমি কিছুই জানি না। তুমি অনেক বড় হও বৃষ্টি দিদি। জীবনের সব পরীক্ষায় তোমায় প্রথম হতে হবে না। তুমি জীবনের পরীক্ষায় প্রথম হও। মানুষের মত মানুষ হও।

বেলা গড়ায়, স্নান সেরে কাজে বের হই। আমার বাড়ির গলির মধ্যে এক শিশু কন্যা কে তার মা শেখায় – আমি যেতে যেতে শুনি – ষড়ভুজ, চতুর্ভুজ, অস্টভূজ, সব। বাচ্চাটির বয়স বড়জোর তিন বা চার। এখন থেকেই তোমার লক্ষ্য স্থির হয়ে গেছে। তোমার গান্ডিবের জ্যা থেকে তীর মাছের চোখে লাগতে হবে। এপাশ ওপাশ হওয়া চলবে না।

আগে সাড়ে সাত টার মধ্যে বের হয়ে সাড়ে আট টায় অফিস ঢুকতাম। এখন সাড়ে দশটায় কাজে যাই। ২২২ নম্বর বাসে জানলার ধারে বসে ঢুলতে থাকি। অলস জীবনের একটা লক্ষণ। হটাৎ হই হট্টগোলে ঘুম ছুটে যায়। ধড়মড করে উঠে পড়ি। সবাই বলছে “এই জোরে চালাও” আমিও গলা মেলাই। আবার থুতনি বুকে ঠেকিয়ে ঘুম। রবীন্দ্রসদন বা তার কাছে আসলে ঘুম ভাঙ্গলো। সজাগ থাকি। ক্যাথিড্রাল রোড দিয়ে হু  হু করে কত গাড়ি ছুটে চলে। নানারঙের নানারকমের। আমি তাদের সবার নাম জানি না। কিছু কিছু গাড়ি তো পেল্লাই লম্বা – ঠাকুর দালানের মত লম্বা – দেখলেই মনে হয় ভীষণ দামী ও নামী। পিছনের সিটে কাঁচ তুলে ঠান্ডা মেশিন চালিয়ে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে মুঠো ফোনে ব্যস্ত এক হোমরা চোমরা। আমার এদের দেখলে কষ্ট হয়। এরা আমার মত মাটির কাছে থাকতে পারে না। হয়তো বা দশতলা বাড়ির উপর থেকে শহরটাকে দেখে। এরা আমার মতন রাস্তার দোকান থেকে কাগজের কাপে বিস্কুট সহযোগে চা খেতে পারে না, পারেনা বেন্টিং স্ট্রিটের রাস্তার ধারে পণ্ডিতের দোকান থেকে শাল পাতার বাটিতে কচুরি জিলিপি খেতে। টিউব কলের তলায় হাত পেতে ঠান্ডা জল খেতে পারে না। চৈত্র সেলে হাতিবাগান এর ভীড় ঠেলে ঘেমে নেয়ে বালিশের ওয়াড় কিনতে পারে না। হাইজিনের জুজু এদের তাড়া করে বেড়ায়।

কাজে পৌঁছাই। কাজ করি মাসের শেষ দিনের দিকে তাকিয়ে। বিল জমা দিয়ে টাকা নিয়ে বাড়ি যাই। দিনের শেষে ক্লান্ত লাগে। মেট্রোর ভিড় ঠেলে, অটোর লাইনে ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসি। পথ চলতে চলতে মানুষ লক্ষ করি। কত চরিত্র – মজার, হিংসার, বিদ্বেষের, বিদ্রুপের। বয়স বেড়েছে , বিদ্রুপ তো শুনতে হবেই – এটাই দস্তুর। চুলের পাক, কম দৃশ্যমানতা, কানে কম শোনা, ছোট বড় অসুখের আনাগোনা – এতো বার্দ্ধক্যের লাঠি। অনেকটা ” বঙ্গ জীবনের অঙ্গ” এর মতন। মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করি। যারা আমায় উপহাস করে, বিদ্রুপ করে, আসলে তারা হিংসে করে। কোন এক হীনমন্যতায় ভোগে। তাইবলে আবার এটা ভেবে বসো না যে আমি superior.

সাঁঝের বেলা বাড়ি ফিরে চা মুড়ি খেয়ে বই পড়ি। কোনদিন টিভির পর্দায় চোখ রাখি, কোনদিন ল্যাপটপ খুলে কিছু পড়ার চেষ্টা করি। দুনিয়ায় কত কিছুই তো জানা হল না, পড়া হল না। এত বড় সাহিত্য সমুদ্র, তার কতটুকুই বা আস্বাদ নিতে পারলাম? জীবনের উপান্তে এসে হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, না পারার পাল্লা যে পারার পাল্লার থেকে অনেক ভারী। শেষ বয়সে এসে যদি কিছু সাহিত্যের আস্বাদ নেওয়া যায় তার চেষ্টা করি মাত্র। এটাই তো আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো, বাকি সবই তো এখানে ছেড়ে যেতে হবে। আমি যে স্বার্থপর তাই যা কিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় তার দিকে নজর বেশী।

রাত বাড়ে, শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয় এই বুঝি ছেলের ফোন আসবে। যদিও তার মায়ের সঙ্গে ছেলের রোজ কথা হয়। তবুও। অপেক্ষা আর প্রতীক্ষার ঢেউ কুঁচকুঁচ খেলার ভিতর দিয়ে কখন যে ঘুমের দেশে চলে যাই টের পাই না। ঘুম ভাঙ্গল যখন, তখন মধ্য রাত। কোন দিন আবার শুয়ে পড়ি, কোন দিন ঘুম আসে না। এঘর ওঘর পায়চারি করি, বই- কাগজ পড়ে রাত কাটাই।  এই তো সেদিন, মধ্যরাতে খাবার ঘরের জানালা খুলে জ্যোৎস্না স্নাত রাত দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। পাশের ডোবায় ওকে? ফ্যাকাশে মুখ, কালো ডাইনিং শুট – এযে ১৯০০ শতকের কাউন্ট, কাউন্ট ড্রাকুলা। ব্রাম স্ট্রোকার এর বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা। ভয়কে জয় করে, সাহসের ডানায় ভর করে একটু ভালো করে ঠাউর করতেই, নিজের উপর লজ্জা লাগলো। আরে এটাতো কলাগাছ, রোজ দেখছি। যত্তসব বুড়োটে ব্যাপার।

See Also
Personal and Professional world of a writer

এমনি করেই রাত শেষ হয়ে নতুন দিনের আগমনী বার্তা শুনতে পাই। রঙ্গীন লিফাফায় মোডা চিঠির মত।

আবার একটা নতুন ভোর।।

 

What's Your Reaction?
Excited
7
Happy
6
In Love
4
Not Sure
5
Silly
3
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top