আমার কৈশোরবেলার দুষ্টুমি



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
দুষ্টুমি না বজ্জাতি – দোদুল্যমান অবস্থা, এই করেই কেটে গেল কৈশোর। যত বদবুদ্ধি সবই বোধহয় ষোল সতেরো বছরের ছেলেটির মধ্যে। আপনারা বিচার করে বলবেন এগুলো দুষ্টুমি না বজ্জাতি। রাজকুমার মুখার্জির কলমে উঠে এসেছে সেই ফেলে আসা দিন।
ছোট বয়সে যেটা দুষ্টুমি থাকে, বয়স যত বাড়তে থাকে, সেই দুষ্টুমি একটু একটু করে বজ্জাতি হয়ে যায়। দুষ্টুমি তখন একটা অন্য মাত্রা নেয়। আসুন আজ একটা দুষ্টুমির বা বজ্জাতির গল্প বলি। সেই দুষ্টুমি যাকে আমার মনে হয়েছে বজ্জাতি বললে অত্যুক্তি হবে না।
আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ি সেটা ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল। কলকাতার ভবানীপুর, হাজরা, চৌরঙ্গী, ময়দান অঞ্চল জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। পাতাল রেলের কাজ হচ্ছে। গান্ধীজীর স্ট্যাচু পার্ক স্ট্রিটের মোড় থেকে চলে গেলেন মেয়ো রোডের মুখে। পার্ক স্ট্রিট, ময়দানে মাটি কেটে জমা হতে হতে ছোটখাটো টিলার আকার নিয়েছে। আশুতোষ মুখার্জী রোড, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী রোড সব বন্ধ। বাস চলছে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে। পাতাল রেল প্রথম দফা চালু হয় যতীন দাস পার্ক থেকে এসপ্ল্যানেড।
আমরা বাস ধরতে হরিশ মুখার্জী রোডে আসতাম। গলির রকে বসে সারাদিন আড্ডা মারি, কত রকমের গাড়ি যায় দেখি। সরকারি বাস বেশিরভাগই ছিল দোতলা। দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায় গজ কাজ করছে। কলেজ থেকে বাসের কন্সেশন কার্ড বার করে নিয়েছি 2B L 1 বাসে যত ইচ্ছে চড়ে ঘোরা যাবে।
দোতলা বাসের এক্কেবারে সামনের সিটের পায়ের কাছে বাসের রুট নাম্বার লেখা একটা খোপ থাকত কাঁচ লাগানো, রাস্তা থেকে লোকের নম্বর দেখে বাসে উঠতে পারবে। কাপড়ের উপর নম্বর লেখা 2, 2B, 3, 5, 6 এইরকম। খোপ টা ছিল ছোট, পাশে আরেকটা বড় খোপ ছিল একই রকম দেখতে, সেখানে লেখা থাকতো বাসটা কোথা থেকে কোথায় যাবে। দুটো খোপের হাতলগুলো ছিল লোক যেখানে বসে সেখানে। এই হাতল গুলো ঘুরিয়ে বাসের নম্বর আর যাত্রা পথের বিবরণ বদলানো যেত। কলেজ যাবার পথে বা ফেরার পথে বাসের দোতলায় উঠে সামনের সিটে বসে পড়তাম বাস ছেড়ে একটু এগোলে নম্বরের হাতল ঘুরিয়ে দিতাম। 2B বাস নম্বর ঘোরাতে ঘোরাতে 6 হয়ে যেতো বা 8B। রাস্তায় লোকে দাঁড়িয়ে ভাবতো এই রাস্তায় তো 8B যায় না, তবে কি কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে, তাই বাস ঘুরিয়ে দিয়েছে।
আপনি একে কি বলবেন দুষ্টুমি না বজ্জাতি? আমি অবশ্য একে দুষ্টুমি তখনই বলতাম যদি এটা একদিন হতো। আমি তো পাজির পাঝাড়া, প্রায়শই এইরকম করতাম এটা বজ্জাতি।
একদিন কোন কারনে বাসের কন্ডাক্টার দেখে ফেললেন। সবার সামনে খুব বকুনি দিলেন। বাসের কেউ কেউ বললেন ‘আহাঃ, ছেলেমানুষ ছেড়ে দিন”। কেউ কেউ ব্যাপারটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলেন। আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না।
সবাই নির্দিষ্ট স্টপ আসার একটা স্টপ আগে সিট ছেড়ে উঠে গেটের কাছে এগিয়ে যান। আমি একবার সিটে বসলে, বাস স্টপে এসে দাঁড়াবার পর, সিট ছাড়তাম। আমার বন্ধুদের বলতাম “বুঝলি এটাকে economics এর ভাষায় বলে maximum utility। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখা আমার মনে হয় উচিত। ওই সময় বাসে বা ট্রামে বয়স্ক লোকেদের জন্য কোন সিট বরাদ্দ থাকত না। আমার বাবাকে দেখতাম কোন বয়স্ক মানুষ বাসে উঠলে বাবা তাঁকে ডেকে নিজের সিটটা ছেড়ে দিতেন বলতেন “আপনি বসুন।” ওটা দেখে আমিও শিখেছিলাম বয়স্ক মানুষদের সিট ছেড়ে দিতে হয়। এটাকে দুষ্টুমি বা বজ্জাতি বলে আখ্যা দেবেন না প্লিজ।
শেষ করবো একটা দুষ্টুমি বা বজ্জাতির গল্প বলে। আসলে এগুলো যখন ঘটিয়েছিলাম তখন এগুলো ঘটনা ছিল, আজ জীবনের উপান্তে এসে এগুলো সব গল্প হয়ে গেছে।
আশুতোষ রোড বন্ধ ট্রাম খিদিরপুর ঘুরে জজ কোট রোড হয়ে হাজরা হয়ে দক্ষিনে যেত। কালীঘাট থেকে লম্বা বুলেবার্টের উপর দিয়ে ট্রাম চলত রাসবিহারী থেকে টালিগঞ্জ হয়ে একদিকে অন্যটা রাসবিহারী থেকে গড়িয়াহাট হয়ে বালিগঞ্জ। কলেজ ফেরত ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ট্রাম স্টপ থেকে যেই ছেড়ে বের হতো, অমনি দৌড়ে গিয়ে ট্রামের মাথায় যে টিকি লাগানো আছে, যেটা উপরে ইলেকট্রিক তারের সঙ্গে লাগানো, তার এক প্রান্ত মোটা একটা দড়ি দিয়ে ট্রামের পেছনের বগির সঙ্গে আটকানো, সেই দড়ি টেনে টিকি টা খুলে দিতাম। ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি দৌড়ে গিয়ে ফুটপাতে উঠে মজা দেখতাম। কন্ডাক্টর ট্রাম থেকে নেমে সেই দড়ি ধরে এপাশ-ওপাশ করে তারের সঙ্গে পুলি লাগিয়ে ট্রাম চালু করতন।
যার মাথায় এত দুষ্টুমি বা বজ্জাতির পোকা কিলবিল করে, তার লেখাপড়া হওয়া দুষ্কর। সেটা আমার পিতৃদেব বুঝেছিলেন তাই মাঝে মাঝে বলতেন “মানুষের মতন মানুষ হও”। আজ তিনকাল গিয়ে এককালে এসেও বুঝতে পারলাম না সৎ থেকে লাভ কি হল? দৈন্য দুর্দশার নাগপাশে বাঁধা পড়ে আছি। মাঝ থেকে আমার শৈশব কৈশোরের দুষ্টমির দিনগুলো কালের স্রোতে হারিয়ে গেল।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.
I was very pleased to uncover this great site. I need to to thank you for ones time for this fantastic read!! I definitely appreciated every bit of it and I have you bookmarked to look at new information on your blog.