আমার আমি
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
“আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা” যেমন সকলের খুব ভালো লেগেছিল সেই রকমই রাজকুমার মুখার্জির আরেকটি মজার গল্প “আমার আমি” পড়ে দেখুন ভালো লাগবে।
আমি চিরকালের ম্যাদামারা। ব্যক্তিত্ব, মানে যাকে ইংরেজিতে personality বলে, আমার চিরকালের অভাব। ছোট বয়স থেকে লোকের ফাইফরমাশ খেটেই আমার জীবন চলেছে, আজও তার কোন ব্যতিক্রম নেই।
যখন ছোট ছিলাম তখন মা কোন খাবার দাদাকে, আমার সঙ্গে ভাগ করে খেতে বললে, আমি পেতাম মুষিক ভাগ, দাদা নিতো সিংহভাগ। মা হয়তো দুটো কলা দিয়ে দাদাকে বললেন “ভাইয়ের সাথে ভাগ করে খা।” দাদা দেড়খানা কলা নিয়ে আমায় আধখানা দিয়ে বলতো “এই নে, আর পাবি না।” মা’র কাছে যে নালিশ করবো, সে পথ বন্ধ। দাদা বলতো “মাকে বললে, হেব্বি মারবো।” দিদির স্যাঙাৎ হয়ে কুলের আচার বা আমের আচার চুরি করে আনার পর, বখরা কখনো সমান সমান হয়নি। আমি ওই অল্পেই সন্তুষ্ট।
ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, ইস্কুল ছুটি।শীতকাল, পড়াশোনার কোনো পাট নেই। সন্ধ্যা হলেই আইস পাইস খেলা। পাড়ার বন্ধুরা বললে “তোকে খেলতে নিতে পারি, তবে তোকে চোর হতে হবে।” এটা প্রথম দিনের শর্ত। আমি ভীতুর ডিম, জোর গলায় বলতে পারলাম না “গোনা হোক; যে চোর হবে, সে খাটান দেবে।” প্রথম দিন খাটান দেয়া শুরু হল। রোজই ‘ধাপ্পা’। আবার খাটান দাও। যেন একাউন্টের ব্যালেন্স ক্যারি ফরওয়ার্ড হচ্ছে। এমনি করতে করতে পুরো ছুটিটা খাটান দিয়েই কেটে গেলো।
আমার জেঠিমা খুব ভালো গান গাইতেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে শ্যামা সংগীত। জেঠিমার খুব ইচ্ছে আমি গান শিখি। জেঠিমা গান ধরেছেন:
‘ রাঙা জবা দিতে তোরে, এনেছি মা দুহাত ভরে–
ও তোর চরণ দুটি মায়ায় ঢাকা, কতো যোগী কেঁদে মরে। ‘
‘যোগী’ তে গিয়ে গলা কাঁপিয়ে নীচু থেকে উঁচুতে, একটু থেমে ‘কেঁদে মরে’ — আহা কি মধুর শুনতে লাগতো! আমাকে বললেন “নাও, এবার তুমি গাও।” আমিও ওই রকম গলা কাঁপিয়ে যেই ‘যোগী’ অবধি গেয়েছি, জানলার পাশ থেকে ভুলু আমাদের পাড়ার কুকুর, তাল মিলিয়ে ভৌ ভৌ ভৌ….. ভৌ-উ-উ-উ-উ। জেঠিমা হারমোনিয়াম বাজানো থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভাবছেন এমন তানসেন কোথা থেকে এলো!! জেঠিমা মাকে দুঃখ করে বললেন “ভেবেছিলাম গানটা হবে। কিন্তু কাকের মতন এমন বিচ্ছিরি গলায় গান হয় না।” আমার ‘কুন্দনলাল সাইগল’ সাহেব হওয়া হলো না। এখন জেঠিমা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন, আমি বেলোর সামনে যে আটটা ফুটো আছে ওর মধ্যে কোন আঙুলটা ঢুকবে সেটা ভাবতে থাকি। মাঝে মাঝে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে দেখি কতটা হাওয়া ওখান দিয়ে বেরোচ্ছে।
বিয়ের আগে জোর কদমে প্রেম চলছে। বেলবটম প্যান্টুল, চেক চেক জামা, বাবড়ি চুল। রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হবু স্ত্রী রাস্তা পার হতে গিয়ে একজনের সঙ্গে ধাক্কা, মাঝ রাস্তায় চিৎ পটাং। আমি দৌড়ে পৌঁছাবার আগেই একজন হাত বাড়িয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে হিরো। আমি যখন পৌঁছালাম, বাসি খবর হয়ে গেছে। আমার কপাল চিরকালের মন্দ। সেই হিরোর উপর রাগ হচ্ছিলো। তুই বাপু দু মিনিট অপেক্ষা করতে পারলি না? আমি এসে না হয় হাত ধরে তুলতাম। আমার জিনিস, তুমি কে হে? তা নয় রাস্তায় গাড়ির জ্যাম লাগিয়ে ন্যাকা ন্যাকা গলায় আবার বলা হচ্ছে “আপনার লাগেনি তো দিদি?” ওরে ব্যাটা, আমায় জিজ্ঞেস কর। আমার বুকের ভেতরে লেগেছে। ভগবান বড্ড একচোখো। আমায় হিরো হবার কোন চান্সই দিলো না, শুধুই জিরো।
বাঙালি ছেলেরা গড়পড়তা পঞ্চাশের আগে কখনোই অ্যাডাল্ট হয় না। মানে ওই সময় তাদের সাধারণত মাতৃ বিয়োগ হয়। তারপর হঠাৎ নিজেকে একদিন আবিষ্কার করে সে গৃহকর্তা। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, স্ত্রী কথা শুনতে চায় না। স্ত্রীর দেখাদেখি ছেলে মেয়েরা। আমার এখন অবস্থা কতটা সেই রকম। সে কথায় পরে আসছি।
ছোট বয়সে লোকে যা বলতো, তাই বিশ্বাস করতাম। পরে দেখেছি সেসব বেশিরভাগই বাজে কথা। কেবল ছেলে ভোলানো।
তখন ভবানীপুরে থাকি। বছরে একবার আমার দিদিমা আসতেন এবং বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়ি থাকতেন। আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে। আমার স্ত্রী বাড়িতে নতুন। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটু আড়াল আবডাল খুঁজি স্ত্রীর সঙ্গে একটু ইয়ে — মানে ভালোবাসার কথা বলবো। সে উপায় নেই। আমার দিদিমা আমার সহধর্মিনীকে নিয়ে তখন গল্প শোনাচ্ছেন। যে সে গল্প নয়। বিরাট গল্প, রাজা বাদশার গল্প। নর্দান পার্কের কাছে দিদিমার মেজমামা থাকতেন। হাইকোর্টের মস্ত ব্যারিস্টার। খুব নামিদামি সব ক্লায়েন্ট। সব রাজা-মহারাজা। তাঁদের বাড়িতে দিদিমার মেজোমামা এবং মেজ মামিমা কোন অনুষ্ঠানে গেলে, সঙ্গে যেতেন দিদিমা। সেই সব রাজবাড়ির গপ্পো।
দিদিমার সঙ্গে রোজ বাড়িতে কেউ না কেউ দেখা করতে আসতো। বাড়ি সরগরম। দেখা করার দলে থাকতেন দিদিমার ছোট ভাই এবং তার স্ত্রী — গাবু মিত্তির, দীপা মিত্তির। গাবু মিত্তির লম্বা লম্বা গুল মারতেন। আমি হাঁ করে শুনতাম। আমার স্ত্রী, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো। একবার গুল মারতে মারতে দিদিমা কে বললেন “আমি এবার দীপাকে নিয়ে নৈনিতাল, রানীক্ষেত, আলমোড়া সব ঘুরে এলাম। দশ দিন। ট্যাক্সি ভাড়া কত দিলাম জানো? পঞ্চাশ হাজার!” যে সময়ের কথা, সেটা ১৯৮৮ সাল। তখন পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম অনেক। এই গুলটা ঠিক জমলো না দেখে এবার খাপ থেকে তরোয়াল বার করলেন। বললেন “জানো দিদিভাই, হঠাৎ দেখি দীপার এক বন্ধু, বিলেত থেকে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি পাঠিয়েছে। বাকিংহাম প্যালেস এর লাইব্রেরীতে আমার লেখা বইটা দেখেছে। সেই বইটা বিলেতে রানীকে ইংরেজিতে তর্জমা করে শোনানো হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, উনি এরিক ফন দানিকানের লেখা ‘The Gods were Astronauts (ভগবান কি গ্রহান্তরের মানুষ) বইটির একটি সমালোচনা লিখেছিলেন যার প্রকাশক তার স্ত্রী এবং আমার জানা ওই একটি বই তাঁর লেখা।
আমার পিতৃদেব এই ঘটনা শুনে ঘর থেকে ছিটকে বাইরে চলে গেলেন, সঙ্গে আমি। বাইরে এসে মাকে বললেন “তোমার মামা হাওড়া ব্রিজের মতন লম্বা আর মনুমেন্টের মতন উঁচু গুল মারছেন।” আমি চিরকালের ক্যাবলা, বুঝতে পারলাম না এর সঙ্গে গুল মারার কি সম্পর্ক?
বয়স অল্প, গাবু মিত্তিরের মতন আমারও লেখার নেশা চেপে বসলো। পাড়ার মনিহারি দোকান থেকে এক দিস্তা সাদা কাগজ, কলম কিনে লেখা শুরু করলাম। ভেবেছিলাম মাইকেলের মতন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখব, তবে গদ্যে। ঘোঁত খাওয়া ঘড়ির মতো থুতনিটা বুকে ঠেকিয়ে, নেওয়া পাতির ভুঁড়ি বাগিয়ে, চেয়ার টেবিলে বসে আমার কাব্য রচনা শুরু হলো। আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ভাবলেন বোধহয় কোন সুপ্ত প্রতিভার এইবার বিকাশ ঘটবে। আমার লেখা ‘জ্ঞানপীঠ’ বা ‘একাডেমী,’ নিদেন পক্ষে ছোটখাটো একটা পুরস্কার তো পাবেই। ডিসেম্বরের শীতে ভোররাত থেকে উঠে, আলোয়ান মুড়ি দিয়ে লেখা শুরু — কি ঝকমারি!!
দিস্তে কাগজ লিখে শেষ করে ফেলার জোগাড়। ক্লাইম্যাক্সে লেখা পৌঁছে গেছে। নর্দমার মুখে ব্যাঁখারি দিয়ে খুঁচিয়ে দেবার পর হড়হড় করে যেমন জল বেরোয়, আমার কলম থেকে সেই রকম লেখা বের হচ্ছে। মা সরস্বতী নাকি দুষ্ট সরস্বতী জানিনা, লেখা চলছেই। স্ত্রী যত বলেন একটু দেখাও, আমি ততই বলি ধৈর্য ধরো একদম শেষে দেখবে।
‘শেক্সপিয়ারের কালো ভুতভুতে ওথেলো, ক্রিম মেখে ফর্সা। ওথেলোর সঙ্গে ঘটোৎকচের ভীষণ লড়াই। জুজুৎসুর এক প্যাঁচে ঘটোৎকচকে মাটিতে ফেলে ওথেলো সীতাকে হুডখোলা জিপে চড়িয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে মিশরের ফারাও তুতেনখামেনের চ্যার্টার্ড প্লেনে ‘ট্রয়’। পাইলট-সুদূর ম্যাসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট। এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসেছে কর্ণ, অশ্বথামা, পরশুরাম। পরশুরাম মুখের মধ্যে দু আঙুল পুড়ে সিটি মারছে আর বলছে “গুরু চালিয়ে যাও, আমরা তোমার পাশে আছি”। ফারাওয়ের ভাড়াটে সৈন্যদল কলাশনিকভ বন্দুক নিয়ে এয়ারপোর্টে বিদায় অভিবাদন জানাচ্ছে।’ এই ছিল আমার কাব্যের দুর্ধর্ষ ক্লাইম্যাক্স।
আমার স্ত্রী, আমার সেই অসামান্য কাব্য, আমার অগোচরে, পিতৃদেব কে শুনিয়ে আমার প্রতিভার গোড়ায় কুঠার আঘাত হানলেন। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই বাবা অগ্নিশর্মা। হাতে, আমার লেখা Manuscript । খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে বললেন “উজবুক”। আমার স্ত্রী ফিক্ করে হেসে পালিয়ে গেলো। আমার খুব রাগ হচ্ছিল আমার স্ত্রীর উপর। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না — ওই যে ব্যক্তিত্ব। কালিদাস হবার বদলে হলুম হরিদাস। হরিদাস পাল।
গাবু মিত্তিরের ঐরকম লম্বা লম্বা গুল আর আমার সাহিত্যের গুঁতো, বাবা সহ্য করতে পারলেন না।মাসখানেকের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। খুব কষ্ট পেয়েছিলুম। ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলুম। স্ত্রী এসে চুপিচুপি বলে গেলো “বাড়ি ভর্তি লোক, তুমি একটা দামড়া, ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লজ্জা করে না?” এক দাবড়ানিতে কান্না থেমে গেলো। আমার স্ত্রী বুঝে গেলেন আমি একটা ল্যাদাড়ুস, আমায় দিয়ে কিস্যু হবে না। আমার ব্যক্তিত্বের বেলুনের হাওয়া বেরিয়ে গেলো।
এখন আমি যা বলি আমার উনি তার বিপরীতে বলেন। আমি যদি বলি ডান, উনি বলেন বাম। অবশেষে আমরা দুজনে দীর্ঘ বৈঠক করে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছালাম; যা কিছু ছোট ছোট ব্যাপার, সেগুলোর সব চিন্তা, ভাবনা, সিদ্ধান্ত নেবেন আমার উনি। যেমন ছেলে কোন স্যারের কাছে পড়বে, পুজোতে কাকে কি দেয়া হবে, আমি কখন অফিস যাবো, বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে কাকে কাকে বলা হবে – এই সব। আমার দায়িত্ব হল বড় বড় সবকিছুর চিন্তা, ভাবনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওপেক দেশগুলোর তেল উৎপাদন বাড়ানো উচিত কি না? রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরবর্তী বৈঠকে ভারত-পাকিস্তান উগ্রপন্থী কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনার সময়ে যদি চীন ভেটো দেয় তবে বিদেশ মন্ত্রীর কি করা উচিত — ইত্যাদি, প্রভৃতি। এখন আমাদের আর ঝগড়া হয় না।
বর্তমানে ভবানীপুরে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বেহালা সখেরবাজার অঞ্চলে। তাও বেশ অনেক বছর হয়ে গেলো। অঞ্চল বললে ভুল হবে, সখের বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। ভবানীপুরে মশা নেই, এখানে মশা আমাদের নিত্যসঙ্গী। বাড়ির পাশে বনবাদাড়, মশা তো থাকবেই। দিনের বেলা যা হোক তা হোক, সন্ধ্যের পর মুখের সামনে চায়ের ছাকনি ধরে কথা বলতে হয়, নয়তো মুখে মশা ঢুকে যাবে। গলির একদম শেষে বাড়ি। সন্ধ্যের পরে আমাদের বাড়িতে আসলে মনে হবে বোধহয় সুন্দরবনের জঙ্গলের ধারে বাড়ি। আমাদের বাড়ি শেষ, তারপর নিকষ কালো অন্ধকার।
বাড়ির গলির মুখের রাস্তা ভাঙা, প্রায় দু’বছর। আমার স্ত্রী ওই রাস্তার জন্য মাঝে মাঝেই গজর গজর করেন। আমি ভয় কুঁকড়ে থাকি। এই যদি আমার ঘাড় ধরে বলে “তোমার জন্যই রাস্তা খারাপ।” যাক্ সে কথা। রাস্তা এমনই খারাপ যে অটো চলতে চায় না, রিক্সা আসতে চায় না। বৃষ্টি হলে খানাখন্দে জল ভরে যায়, সেইসঙ্গে দইয়ের মতন কাদা। তারই মাঝে আমি লাফিয়ে লাফিয়ে যাই বাজার দোকান। অনেকটা ছোট বয়সে কুমিরডাঙা ফেলার মতন। ‘ও কুমির তোমার জল কে নেমেছি’।
যেহেতু বাড়ি গলির শেষে তাই ফেরিওয়ালা বাড়ির কাছে এসে হাঁক পাড়ে না। সে একদিকে ভালই হয়েছে। তবে মুশকিল হয়েছে নোংরা ফেলার গাড়ি। সে ওই দূর থেকে বাঁশি বাজিয়ে চলে যায়, ঘরের মধ্যে বসে শুনতে পাই না। ভোর থেকে কুকুরের মতন বারান্দার চেয়ারে বসে পাহারা দিই। সবে খবরের কাগজটা খুলে পড়া শুরু, ব্যাস বাঁশি বেজে উঠল। স্যান্ডো গেঞ্জি-হাফ প্যান্ট পরে, নোংরার বালতি নিয়ে দে ছুট। তখন আমিই বা কে আর উশান বোল্ট ই বা কে!
নোংরা ফেলে এসে নিস্তার নেই। সাবান দিয়ে হাত ধোও। শুধু নোংরা ফেলা, যতবার বাইরে যাবে, ততবার হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। কি কঠিন নিয়ম রে বাবা। হাত ধুতে ধুতে আমার হাতে হাজা ধরে যাবার যোগাড়। আমি না বলতে পারি না, সে মুরোদ নেই। যতই লম্বা-চওড়া বুলি আওড়াই না কেন, বাড়িতে মেনি বেড়াল। ভেবেছিলাম নেকড়ের মতো তীব্র হব, হলাম ন্যাকড়ার মত ন্যাতানো।
এবার হাত ধুয়ে এসে দেখি পাখার হাওয়ায় বারান্দার টেবিল থেকে খবরের কাগজ মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি। তাকে গুছিয়ে পাতার সঙ্গে পাতা মিলিয়ে সবে পড়ব পড়ব করছি-পাখা বন্ধ। রুনু, আমাদের কাজের মেয়েটি পাখা বন্ধ করে ঝাঁট দেবে, মুছবে। আমার অবস্থা এবার বাঁদরের মতন। খাওয়ার টেবিল, সেখানে জলের বোতল ওষুধের শিশি-পুরো টেবিল উদ্বাস্তুদের দখলে। কাগজ ছড়িয়ে বসে পড়ার উপায় নেই। এবার ঘরের বিছানা। বাবু হয়ে বসতে পারিনে, বুড়ো বয়সের রোগ। অগত্যা বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। সব কাজ মিটলে তবে আমি সুযোগ পাবো।
অবসরের পর ভেবেছিল রাজার হালে থাকবো। সে গুড়ে বালি। রানীর ফরমাস খেটে চলো। বাজার থেকে সবজি আনো, সকালে দুধ আনো, পাঁউরুটি আনো–হাজারো কাজ। যদি সবজির মধ্যে পোকা বেরিয়েছে, তবে হয়ে গেলো। বারবার ডেকে এনে কাটা আনাজ দেখাবে। আমি যেন আলু বেগুনের ভেতরে ঢুকে দেখব পোকা আছে কিনা। মাঝে মাঝে এমন সব জিনিস আনতে বলবে, আপনি ভুলে যেতে বাধ্য। ভুলে গেলে আবার যাও।সকালটা তাঁতের মাকুর মতন বাজার বাড়ি, বাড়ি বাজার।
এইতো সেদিন, তা প্রায় বছর দুয়েক হতে চললো। হঠাৎ আমার হৃদয় ময়ূরের মতন না নেচে, ছাগলের মতন লাফাতে শুরু করলো। মা ছেলে মিলে খুব শলা পরামর্শ করলে, তারপর আমায় প্রায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে ফেললে বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে। বাইপাসের ধারের হাসপাতাল যখন, সে তো বাইপাস করেই তবে ছাড়বে। যত বলি এটা কলের মিস্ত্রির মতন কাজ, একটা ধমনী থেকে নতুন রক্তের লাইন টেনে দিলেই হবে। তা শুনবে না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলুম, আমাদের বাড়ির কলের কাজ করে সুজয়, ভারি সুন্দর কাজ করে। ওকে ডাকি, কম পয়সায় হয়ে যাবে। কে শোনে কার কথা। ওই সেই ব্যক্তিত্ব–ধোপে টিঁকলো না। ওরে বাবা সে কি দক্ষযঞ্জ। নাকে, মুখে, বুকে, পেটে, একগাদা নল লাগিয়ে — ওফ্ যেন ‘নল-দময়ন্তী’ উপাখ্যান।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। ঠিক দুপুর বারোটা বাজলেই ছেলে নিজের কাজ ফেলে হাতে দস্তানা পরে, ট্রেতে ওষুধ, গজ, তুলো, জল নিয়ে ড্রেসিং করতে চলে আসছে। তার মা মাঝেমাঝে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছে। বউ সকাল বিকেল ঘেঁটি ধরে হাঁটাচ্ছে। ছেলে ল্যাপটপ নিয়ে আমার পাশে বসে কাজ করছে। নিজের স্বাধীনতা চৌপাঠ। আমিও ছেলের কাছে বায়না করছি। আজকে জুতো কিনে দে, তো কালকে, তোর মত একটা ব্লুটুথ হেডফোন কিনে দে। ছেলে দিচ্ছেও, কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। ভাবছি এবার একটা বড় দাঁও মেরে দেবো। আমার বউ যাচ্ছে রেগে। “খালি বাচ্চাদের মত বায়না”। বোঝাই কি করে আমি তো আমার ছেলের কাছে চাইছি অন্য কারো কাছে নয়। এখানেও ওই ব্যক্তিত্ব, মনের কথাটা বলতে পারলাম না বউ এর কাছে।
ইদানিং আমার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। পাড়ার মিষ্টির দোকানে আগে লুকিয়ে লুকিয়ে জিলিপি সিঙাড়া খেতাম। এখন আমায় বেচে না। প্রথমে বুঝতে পারি নি, পরে জানলুম ছেলে বারণ করে গেছে। কদিন খুব রাবড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। ছেলেকে বললম “আড়াইশো রাবড়ি খাওয়াবি?” এমন চিৎকার জুড়ে দিল “ও মা দেখো, বাবা রাবড়ি খেতে চাইছে। যার চার বেলা ইনসুলিন নিতে হয় বাইপাস হয়ে গেছে, বলে রাবড়ি খাবে।” রাবড়ির বদলে এলো ডাইজেস্টিভ বিস্কুট। ভুসি মাল, শুধু ইসবগুলের ভুষি দিয়ে বানানো। সে আবার একটা দুটো নয়, গুচ্ছের। খেয়ে শেষ করা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে পাড়ার কুকুরকে দিয়েছিলাম। শুঁকে চলে গেছে, খায়নি। যদি এতই ভালোবাসা তাহলে ডার্ক ফ্যান্টাসি, ওরিও, বর্বন, কমপক্ষে চিনি ছড়ানো নাইস-এসব তো আনতে পারতিস। বলা হলো না। সেই ব্যক্তিত্বের অভাব।
বাড়িতে একটা টিভি। ভারত পাকিস্তানের খেলা হোক বা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা, সে সময় যদি দিদি নাম্বার ওয়ান চলে বা অন্য কোন প্রিয় অনুষ্ঠান, খেলা দেখা যাবে না। আগে রিমোট কেড়ে নিতো, এখন আমি পুরুষ সিংহ রিমোট কেড়ে নিতে দিই না। আমার হাতের মুঠোয় টিভি রিমোট। তবে কোন চ্যানেল চলবে এবং কত ভল্যুয়ুমে চলবে সেটা ঠিক করে বউ। হাতে রিমোট পেয়েছি, একটু একটু করে এবার ব্যক্তিত্ব ফিরে পাবো। একটু সময় লাগবে, ধরো আরও বিশ বছর। ক্ষতি নেই। উঁহু বাবা, আমি সহজে হারবার পাত্র নই। ‘আমার মুরগি যায় যাক্, শিয়ালের আক্কেল দেখে তবে ছাড়বো। খামারের দরজা বন্ধ হবে না।’ জীবন যায় যাক রিমোট ছাড়বো না।
বাড়িতে চারজন লোক খাবে ভালো মন্দ রান্না হচ্ছে। আমি ছোঁড়া চাকরের মতন দশ বার দোকানে যাচ্ছি। আশায় আশায় আছি বিড়ালের ভাগ্যে শিখে ছিঁড়বে। পায়েস হবে- গোবিন্দভোগ চাল, দুধ, কাজু, কিসমিস, চিনি, বাতাসা, এলাচ, সব নিয়ে এলাম। রাতে সবাই খেয়ে চলে যাবার পর খেতে বসেছি, বউকে ভালোবেসে বললাম “পায়েসটা কেমন হয়েছে, দেখি।” পাতে যে পরিমাণ পায়েস পড়ল, তা দিয়ে কপালে ফোঁটা দিলে, কম পড়ে যাবে। আঁতকে উঠে বললাম “একি!” বউ বললে “আজ মাংস টাংস খেলে, কাল খেও।” সারারাত বিছানায় ছটফট করলুম। পায়েসের জন্য মনটা হুহু করতে লাগলো। রাতে চারবার বাথরুমে গেলাম। দু বোতল জল খেলাম। মনকে বোঝানোর কত চেষ্টা, কাল তো পায়েস জুটবে। মন কিছুতেই মানতে চায় না। সকাল হলো, বেলা গড়াতে বউকে বললাম “একটু পায়েস খাবো।” খিঁচিয়ে উঠলো “ভ্যাট”। একটু যে জোর দিয়ে বলবো, সে ক্ষমতা নেই — ওই ব্যক্তিত্ব।
সারা জীবনধরে এরকম যে কত ঘটনা ঘটে, বলে শেষ করা যাবে না। আমার এই না পাওয়ার দুঃখ আমার সঙ্গে চিরকাল রয়ে যাবে। এই তো সেদিন ছেলে দশটা ক্ষীর কদম্ব কিনে এনেছে, আমরা তিনজন। জনপ্রতি তিনটে, একটা ফাউ। খুব আনন্দে আছি। আমি গৃহকর্তা, হয়তো বাড়তি টা আমার। আমার গিন্নি স্কুলের বড়দির মতন মুখ করে একটা ক্ষীর কদম্বকে দু’ভাগ করলে। একভাগ এক তৃতীয়াংশ, অন্যভাগ দুই তৃতীয়াংশ। কি বৈষম্য! আমার হাতে এক তৃতীয়াংশ দিয়ে বললে “আর পাবে না।” এত কষ্ট হল কি বলবো? ক্লাস সেভেনে ফেল করার সময় এত কষ্ট পাই নি।
তক্কে তক্কে রইলাম। মাঝরাতে উঠে খুব সন্তর্পনে ফ্রিজ খুলে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বাকি ক্ষীরকদম্বের হদিস পেলাম না। পরদিন সকালে দেখি খাবার টেবিলে মিষ্টির বাক্স এবং গিন্নি গুনে দেখছেন। এখন আর নেওয়া যাবে না। দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছি, ঘুমটা ভেঙে গেল। গিন্নি পাশে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আবদারের গলায় বললাম “ক্ষীরকদম্ব খাবো।” উত্তরে গিন্নি বললেন “গুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দেবো।” শুনেছিলাম ‘পেটে খেলে, পিঠে সয়’। কি লাভ পেটে না খেয়ে পিঠে সইয়ে? দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম। জুলুম খাটাতে পারলাম না। ‘ব্যক্তিত্ব’ পাঁচিল হয়ে সামনে দাঁড়ালো।
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.