অগ্রপথিকের অভিযান



Suman stays in Shyamnagar, West Bengal. Having keen interest in…
ভাই গোবরচন্দ্রের হয়েছে অ্যাক্টিং এর শখ, প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে সে দাদাকে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তারপর.. পড়ে দেখুন।
লেখক : সুমন অধিকারী
এই দাদা, SRFTI এ পড়াশোনা করতে eligibility criteria টা কি রে??
SRFTI??!! Full form টা জানিস??
Satyajit Ray Film & Television Institute… তুই কি আমাকে গাধা ভাবিস?!
গাধা না গোবর…
ধুর্ বল না..
সেটা জানার অাগে এটা বলতো হঠাৎ করে ‘RO’-hit Shetty ছেড়ে ‘Ray’ তে interest?!
অারে কাল “অপুর সংসার” আর “হীরক রাজার দেশে” ব্যাক-টু-ব্যাক দেখলাম তোর ফ্রি ওয়াইফাই টা ইউজ করে, অসাধারণ লাগল। সৌমিত্র চ্যাটার্জির অসাধারণ অভিনয়…
বাবাঃ, সালমান খান ছেড়ে সৌমিত্র চ্যাটার্জী!! যাক এতদিনে ফ্রি ওয়াইফাই টা একটু ঠিক কাজে লাগালি.. তা কি কাজে লাগবে তোর SRFTI এর info?!
অারে আমি অ্যাক্টিং শিখতে চাই.. সৌমিত্র তে আমি পুরো ফিদা।
সৌমিত্র বাবু বল অথবা সৌমিত্র চ্যাটার্জী। ইনি তোর ইয়ার-দোস্ত নয়।
সরি সরি।
তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক রে! সৌমিত্র বাবুর মতো এক্টিং করতে চাস?! তো সৌমিত্র বাবুর সম্বন্ধে কিছু জানিস?!
জানি মানে ওই, উনি ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অনেক ছবি করেছেন, এইসব। আর একটু বল..
‘একটু’ তো বলা সম্ভব নয় যে মানুষটা সুদীর্ঘ 65 বছর সিনেমা-মঞ্চ-থিয়েটার দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তার কথা ওই ‘একটু’ বলা সম্ভব নয় বা ঐ ‘দু’লাইনে’ বলা সম্ভব নয়।
আচ্ছা আজ-তো স্যাটারডে তোর অফিস ছুটি, বল সময় নিয়ে..
আমার বেশ কিছু কাজ ছিল, কিন্তু মনে মনে খুশিই হলাম। কাজ আপাতত মুলতুবি থাক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর ব্যাপারে কথা বলতে তো একপ্রকার বাঙালি হিসেবে শ্লাঘাবোধ হয়। মনে মনে একটু খুশি হলাম, কিন্তু পুরোপুরি মনের ভাবটা প্রকাশ করলাম না। একালের ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস নেই, কখনো ধৈর্য হারিয়ে ফেলে বলবে ‘একটু ছোট করে বলনা’… তখন আমার গাত্রদাহ শুরু হবে। যাইহোক বলতে শুরু করলাম-
দেখ, সৌমিত্র চ্যাটার্জী শুধু অভিনেতা নন, তাঁর অভিনীত সিনেমা দেখলেই তাকে বোঝা বা জানা পুরোপুরি সম্ভব হবে না। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন।
প্রতিষ্ঠান, মানে ওঁরও অ্যাক্টিং স্কুল আছে?! তাহলে তো ওখানেও এপ্লাই করতে পারি?
এই যে তোর উল্টোপাল্টা কথা শুরু হল.. প্রতিষ্ঠান মানে কি শুধুই ইসকুল হয় রে?! ইনি হলেন এমন একটা দ্যুতি, এক জাজ্বল্যমান নক্ষত্র যার আলোকে গোটা ইন্ডাস্ট্রি আলোকিত হয়েছে।
ওকে ওকে কন্টিনিউ..
তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেন সত্যজিৎ রায়ের “অপুর সংসার”(1959) সিনেমা দিয়ে এটা ছিল “অপু ট্রিলজি” র তৃতীয় অর্থাৎ শেষ অধ্যায়। আশা করি তুই বাকি দুটো অধ্যায় দেখেছিস?! না দেখলে প্লিজ দেখিস..

দেখে নেবো.. দেখে নেবো.. কন্টিনিউ..
হ্যাঁ। আসলে তাঁর আত্মপ্রকাশ ছিল অত্যন্ত ম্যাজিক্যাল। ওরকম সুপুরুষ স্পোর্টসম্যানদের মত চেহারা, অভিনয় দক্ষতা এবং এখনকার ভাষায় “বয় নেক্সট ডোর” ইমেজ প্রথমবার পর্দায় তার অভিনয় দক্ষতা দেখেই দর্শক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল..
সত্যি রে দাদা। এত সাবলীল, যে দেখে মনেই হয়নি, মানে অামি জানতামই না যে “অপুর সংসার” ওনার প্রথম সিনেমা।
কিন্তু দেখ, প্রথম সিনেমাতে অসাধারণ স্ক্রীন প্রেজেন্স বা অভিনয় যেমন ক্যারিয়ারকে মাইলেজ দেয়, ঠিক তেমনই দর্শকদের প্রত্যাশা কিন্তু আরো বেড়ে যায় এবং সেই প্রত্যাশা কিন্তু সকলে পূরণ করতে পারেন না। এই ভাবেই ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’ হিসেবে অনেকেই হারিয়ে যায়। এইখানেই সৌমিত্র বাবুর অনন্যতা, তিনি কিন্তু প্রথম সিনেমার মতোই পরবর্তী ছবিগুলি যেমন “অভিযান” (1962), চারুলতা (1964), কাপুরুষ (1965), অরণ্যের দিনরাত্রি (1969), অশনি সংকেত (1973) এইসব সিনেমাগুলিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। যদিও তিনি এই ছবিগুলিতে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের গাইডেন্স পেয়েছিলেন কিন্তু সেটাতে তাঁর দক্ষতাকে খাটো করা যায়না। এবং প্রতিটি সিনেমাতে তিনি তার ক্রাফট মেন্টেন করেছিলেন।
দাদা, উনি তো ফেলুদাও করেছিলেন কয়েকটা ছোটবেলায় টিভিতে দেখেছি..
কটমট করে এবারে তাকালাম বললাম –
হ্যাঁ, দুটো ফেলুদা করেছিলেন কিন্তু সেটাও তুই দেখিস নি না পুরোটা?!
না..মানে.. দেখেছি অল্প একটু ছোটবেলায়, তারপর ‘সিনচ্যান’ ‘ডোরেমন’ এর টাইম হয়ে যাওয়ায় পুরোটা একেবারে বসে দেখা হয়নি.. হেঁ হেঁ।।
আমি হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম.. মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করলাম, ছোটভাইকে ভালো কিছু দেখাবার দায়িত্ব কিছুটা আমারও, মুখে বললাম-
অবশ্যই পুরোটা দেখে নিস, ভালো লাগবে। ফেলুদা হিসেবে আত্মপ্রকাশ “সোনার কেল্লা” সিনেমায়.. ও এরপর “জয় বাবা ফেলুনাথ”..

দাদা আমরা যখন খুব ছোটবেলায় জয়সালমের এ গিয়ে ছিলাম, যদিও তখন আমি অনেক ছোট, তখন আমরা ওখানে সোনার কেল্লা দেখেছিলাম না?!
এগজ্যাক্টলি.. যেখানে আমি আর বাবা উটের পিঠে চেপে ছিলাম, আর মা বলছিল ওই যে ফেলুদা-মুকুল যাচ্ছে… তোরা অতো মনে নেই কারণ তুই তখন খুবই ছোট।
আচ্ছা দাদা উনি কি সব সিনেমাই খালি সত্যজিৎ রায়ের সাথে করেছিলেন?!
আরে পাগলা, মানুষটা প্রায় আড়াইশো ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। উনি আরো অনেক ও প্রায় তৎকালীন এবং এইকালীন প্রত্যেক পরিচালকের সাথে কাজ করেছিলেন যেমন মৃণাল সেন(“আকাশকুসুম”),তপন সিনহা(“ক্ষুধিত পাষাণ”,“ঝিন্দের বন্দী”),তরুণ মজুমদার(“গণদেবতা”),অজয় কর(“পরিণীতা”) থেকে অঞ্জন চৌধুরী হয়ে শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায় অবধি। তবে তিনি সত্যজিতের মানসপুত্র ছিলেন। আসলে তার অভিনয় দক্ষতা ছিল জলের মতো যে পাত্রে রাখা হতো সেই পাত্রের আকার ধারন করতে পারতেন।
আচ্ছা দাদা, তখনকার দিনে উত্তমকুমার অার সৌমিত্র চ্যাটার্জির মধ্যে নাকি হেবি ঝগড়া ছিল আমাদের মা-বাবার মত?!
হাহাহা, ঝগড়া তাদের মধ্যে ছিল না, ছিল তাদের ফ্যানদের মধ্যে.. দুজনেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, দুজনেই দুজনকে সম্মান করতেন। সৌমিত্র চ্যাটার্জী, উত্তমকুমারকে দাদার মত শ্রদ্ধা করতেন অার উত্তমকুমারও সৌমিত্র চ্যাটার্জী কে ছোট ভাইয়ের মত ভালবাসতেন। কত সিনেমায় দুজনে একসাথে অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে “ঝিন্দের বন্দী”, “স্ত্রী”, “অপরিচিত” উল্লেখযোগ্য।
আচ্ছা, এত ভালো ভালো সিনেমা যখন করেছিলেন তখন তার অ্যাওয়ার্ড ক্যাবিনেট টাও নিশ্চয়ই বড় ছিল?!
অ্যাওয়ার্ড?! সেটা কি আর গুনে শেষ করা যাবে?! তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দু-দুখানা National Award, থিয়েটারে তার অনবদ্য অবদানের জন্য Sangeet Natok Academy Award, এছাড়াও ফ্রান্সের সবথেকে বড় artist সম্মান “Commandeur”, 2004 এ Padma Bhushan award ও 2011 তে Dada Saheb Phalke award. 2013 তে IBN থেকে “The Men Who Changed the Face of the Indian Cinema” award.. তবে কি জানিস ভাই, সবচেয়ে বড় অ্যাওয়ার্ড হচ্ছে- মানুষের ভালোবাসা, নিজের চরিত্রাভিনয় এর মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া.. যেটিতে তিনি অতি সফল।
দাদা, এতগুলো সিনেমার মধ্যে তোর প্রিয় সিনেমা বা প্রিয় চরিত্র কোনগুলো?
দেখ, এভাবে বলা তো সম্ভব নয়। কারণ প্রচুর সিনেমা তিনি করেছেন, তার মধ্যে ভালো, অতি ভাল, অসাধারণ অার কিছু মন্দ ছবিও আছে। তবে কিছু চরিত্র আমার মনে সর্বক্ষণ থেকে গেছে..
বল বল..
“অপুর সংসার”, “হীরক রাজার দেশে”, “ঝিন্দের বন্দী”, “অরণ্যের দিনরাত্রি” এগুলো তো আমার খুবই পছন্দ। আর ফেলুদা, কতবার যে দেখেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। এছাড়াও একালের ছবির মধ্যে অতনু ঘোষ এর “ময়ূরাক্ষী” ছবিতে তাঁর অটিজম আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবার চরিত্র আমাকে অনেক রাত জাগিয়ে ছিল জানিস! শিবপ্রসাদ নন্দিতা রায়ের “পোস্ত” ছবিতে স্নেহশীল দাদুর চরিত্র, আমাকে আমাদের দাদুর কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল। আর “বেলাশেষে”-“বেলাশুরু” ছবির নির্ভরযোগ্য স্বামীর চরিত্র আমাকে আমার চরিত্র গঠনে সাহায্য করেছে। আজও যখন কোনও সমস্যায় থাকি তখন “কোনি” ছবির কোচের ‘ফাইট কোনি ফাইট’ আমাকে সাহস যোগায়.. রিসেন্টলি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের “অভিযান” নামক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অটোবায়োগ্রাফি-ধর্মী সিনেমাটিও আমার ভালো লেগেছে। আরো কত আছে বলে শেষ করা যাবেনা।
দাদা, ওনার থিয়েটার তুই দেখেছিস?
ওনার মাত্র দুটো থিয়েটার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, “রাজা লিয়ার” ও “হোমাপাখি”। এই দুটো নাটক দেখার রাতগুলোতে আমি ঘুমাতে পারিনি, উনার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে কোন কথাই বলার নেই।কিন্তু যেই এনার্জি সেই বৃদ্ধ বয়সেও দেখেছিলাম সেটা অসাধারণ। কতটা ভালোবাসা, ডেডিকেশন থাকলে এরকম পারফর্ম করা যায় সেটা বুঝেছিলাম। এ ছাড়াও অসংখ্য নাটক তিনি ডিরেকশন দিয়েছিলেন এবং অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে “তাপসী”, “টিকটিকি”, “চন্দনপুরের চোর”, “প্রানতপস্যা” উল্লেখযোগ্য।

উনি কি বইও লিখেছিলেন?

একটা দুটো নয় বেশ কয়েকটা। আসলে সিনেমা থিয়েটার করার পর যেটুকু সময় পেতেন সেটা তুমি সাহিত্যচর্চাতেই নিবেদন করতেন। তার লেখা কবিতার বইগুলো পাঠক সমাদৃত, আসলে তিনি তো ভালো আবৃত্তিকার ও ছিলেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন আর সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার যৌবন কালের বন্ধু হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে চর্চা-ও করতেন। তাঁর লেখা “মানিকদার সঙ্গে” আমি পড়েছি, যেখানে তিনি সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো কে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। একটি অসাধারণ পাঠ,আমার কাছে আছে পড়ে দেখিস।
Oh my God.. He was so talented.. Multitasker… আমিতো একসাথে দুটো কাজই করতে পারিনা..
৮৫ বছরের সুদীর্ঘ জীবন পেলেও আজও মনে হয় ওনার আমাদেরকে আরও অনেক কিছু দেবার বাকি ছিল..
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ গোবর বলে উঠল-
দাদা, 500/- টাকা একটু ছাড় না ডেট আছে..
ভাগ্ এখান থেকে, মা-কে বলব?!
তাহলে কি আমিও ছেড়ে দেবো নাকি?! আমিও বলবো। আরে প্লিজ দে-না? নন্দিনীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব।
নন্দিনী?! আচ্ছা.. সেইজন্যই কি তোমার সৌমিত্র চ্যাটার্জী হওয়ার শখ হয়েছে নাকি?! ‘কে তিনি নন্দিনী আগে তো তাকে দেখিনি’
স্যারের ব্যাচে আলাপ..এত কথা এখন বলতে পারছি না.. পরে বলব.. দে না প্লিজ.. না হলে.. ‘আইফোন ধরে মারো টান দাদা হবে খান খান’..
বলেই পাশে রাখা আইফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি করলো.. আমি রীতিমত হাঁ হাঁ করে উঠলাম। অগত্যা ওয়ালেট থেকে 500 টাকা বের করে দিতে বাধ্য হলাম। শ্রীমান গোবরচন্দ্র ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে ফোনটা রেখে দিল। তারপরে মিচকে ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে বলল-
থ্যাংক ইউ.. ফেলু-দা। তোর প্রেম ফেল করলেও আমারটা করবে না.. হেঁ হেঁ হেঁ.।
আগুনঝরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে বললাম-
সাবাস তোপসে…
What's Your Reaction?

Suman stays in Shyamnagar, West Bengal. Having keen interest in literature, books, cinema, drama, sports & food. Now He writes for his own audiobook channel on YouTube named Rusteze Production.